XtGem Forum catalog
মাসিক ভৌতিক
ডিসেম্বর ২০১১
সংখ্যাঃ ৪
বর্ষঃ ০১
একটি প্রভাতী প্রকাশনি ও বাংলা প্রকাশন প্রয়াস
আমাদের কথা
প্রিয় বন্ধুরা ।কেমন আছ তোমরা ?নিশ্চয় ভাল ?প্রতিমাসের মতো তোমাদের ভাল লাগাটাকে আর একটু বাড়িয়ে দিতে এবার নিয়ে এলাম মাসিক ভৌতিক চতুর্থ সংখ্যা ।ডিসেম্বর ২০১১ ।এবার সংখ্যাটা একটু অন্য রকম ।বলতো কেন ?হ্যা ঠিক ধরেছ এবারের সংখ্যাটি একই সাথে প্রকাশিত হচ্ছে আমাদের বিজয়ের মাসে আর ! আর ! ।আরেকটা কি ? আরেকটা হচ্ছে বছরের শেষমাসে । চলো এবার পরিচিত হয় এই পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট যারা তাদের সাথে । Uhtml ফরম্যাটঃ জাবেদ ভুইয়া ,প্রভাতী প্রকাশনি । PDF ফরম্যাটঃ মীর মোঃ আল আমিন ,বাংলা প্রকাশন । পরিচালকঃ ইমরান ভুঁইয়া । সহযোগীতায়ঃ আকাশ ভুঁইয়া । কৃতজ্ঞতাঃ আসিফ ,জুয়েল ,সুজন ,ঝরাপাতা ,মুকুল ,সিহাবউদ্দিন ,কালো ,গোলাপী ,মিতু সহ আরও অনেক । লেখা পাঠাওঃ jabed.bhoiyan@gmail.com এই ইমেইল ঠিকানায় ।
ভৌতিক গল্প : আজরাইল
ঘটনার শুরু আজ থেকে চার বছর আগে এক রাতে। আমি সিলেট এর ওসমানী মেডিকেল এ একটা সেমিনার শেষ করে নিজেই ড্রাইভ করে ফিরছিলাম ঢাকায়। সাধারণত আমার পাজেরো টা আমার খুব প্রিয় হওয়াতে আমি কাউকে ড্রাইভার রাখিনি। সেদিন ওআমি নিজেই চালিয়ে নিয়ে আসছিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। পথে খানিক টা ঘুম ঘুম ভাব আসলেও মন টা সতেজ ছিল- কারন সেই সেমিনারে আমি আমার গবেষনার জন্য পেয়েছি প্রচুর হাততালি। সাংবাদিক রা ফটাফট ছবি তুলে নিয়েছিল আমার। পরদিনপত্রিকায় আমার ছবি সহ লিড নিউজ ও হবার কথা ই ছিল এবংহয়েছিল ও তাই। আমি একটা বিশেষ হার্ট সার্জারি আবিষ্কার করেছিলাম- যেটা আজ পৃথিবীর সব দেশে দেশে রোগীদের জীবন বাঁচাচ্ছে- মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে নতুন জীবনের।সেমিনারের সফলতা তাই জুড়ে ছিল আমার মনে প্রানে। রাস্তায় যেতে যেতে সেদিন আমি গান শুনছিলাম। গানের তালে তালে ধীর গতিতে গাড়ি চালাই আমি। বেশি গতি আমি কখনোই তুলিনা।সেদিন ও ৫০ এর কাছাকাছি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। সিলেট থেকে রওনা দিয়ে উজানভাটি এলাকার কাছাকাছি আসতেই হটাত করে আমার সামনে এক সাদা পাঞ্জাবি পড়া বৃদ্ধ লোক এসে দাঁড়ায়। রাত তখন প্রায় দুইটা। এই সময় রাস্তায় হাইওয়ের গাড়ি গুলো ছাড়া কোন যানবাহন ও ছিলনা। হটাত করে আমার সামনে কোত্থেকে লোকটা এসেপড়ল কিছু বুঝে ওঠার আগেই। আমি ও লোকটাকে বাঁচাতে গিয়ে ও পারলাম না। সোজা সেই লোকের ঊপর চালাতে বাধ্য হলাম। আর সেখানেই গাড়ির সামনের অংশে বাড়ি খেয়ে লোকটা ছিটকে পড়ল হাত পাঁচেক দূরে। আমি হার্ড ব্রেক কষে সেইবৃদ্ধের কাছে ছুটে গেলাম। কিন্তু ততক্ষনে সব শেষ। মাথার কাছটায় আঘাতে মৃত্যু বরন করেছে বৃদ্ধ ততক্ষনে। জীবনে ও আমি কোন দিন এক্সিডেন্ট করিনি।সেটাই ছিল আমার প্রথম এক্সিডেন্ট। আমি দিশেহারা হয়ে যাই। কিভাবেকি করব বুঝে ঊঠতে না পেরে কিছুক্ষন ঝিম মেরে থাকলামসেখানেই। তারপর বৃদ্ধকে গাড়িতে তুললাম। পাশে বসিয়ে আবার ড্রাইভ করলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় পৌছে সোজা মেডিক্যাল এ নিয়ে গেলাম লাশ টাকে। সেখানে গিয়েই পুলিশ কে জানানো হল। পুলিশ এসে আমার কাছ থেকে জবানবন্ধি নিয়ে লাশ টা থানায় নিয়ে গেল। আমি প্রথমে ঠিক করেছিলাম পুলিশ কে সব খুলে বলব। কিন্তু পরে কি ভেবে যেন আমি মিথ্যে বলি। পুলিশ ও আমার কথা গুলো কোন রকম সন্দেহ ছাড়াই বিশ্বাস করে। নিজের কাছে আমি কিছু টা অপরাধী বোধ করলে ও নিজের ইমেজ বাঁচাতে এই মিথ্যেটা আমাকে বলতেই হয়েছে। তারপর কেটে গেছে অনেক গুলো মাস। আমি আমার আবিষ্কৃত প্যারা সার্জারি সিস্টেম এর জন্যঅনেক গুলো পুরষ্কার ও পাই। খ্যাতি আর অর্থ দুটোই এসে ধরা দেয় আমাকে। ধীরে ধীরে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে চলে আমার। নিজেকে কিছুটা ঈশ্বরের সমপর্যায়ের ভাবতে থাকি। এরজন্য মিডিয়া ও কম দায়ী নয়।খবরের পাতায় কারো না কারো জীবন বাঁচানোর জন্য আমি ঊঠে আসতে থাকি নিয়মিত ভাবে। ধীরে ধীরে আমি অনেক অনেক বেশী অহংকারী হয়ে ঊঠি। কাউকেই পরোয়া না করার একটা ভাব চলে আসে আমার মাঝে। মানুষ কে আমি মনে করতে শুরু করি হাতের পুতুল। আমি চাইলেই যেকোন মৃত্যু পথযাত্রীর জীবন বাচিয়ে দিতে পারতাম। এই জন্য আমার কাছেই ছুটে আসতে লাগল হাজারো মানুষ। এই যশ আর খ্যাতি যখন তুঙ্গে তখন আমার কাছেই রুগী হয়ে আসেন বাংলাদেশেরপ্রথিত যশা রাজনীতিবিদ রেজোয়ানুল হক। আমি বাকি সবার মত উনাকেও আস্বস্থ করেছিলাম যে উনার কিছু ই হবেনা। যেদিন উনার অপারেশন – সেদিন আমি আরো দুটি হার্ট অপারেশন করে ফেলেছিলাম। তাই কিছু টা ক্লান্তি ছিল। একটানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপারেশন গুলো করতে হয়। তাই ক্লান্তি ভর করে সহজেই। আমি ক্লান্ত থাকলে ও মনে মনে পুলকিত ছিলাম কারন এর পরেই আমি রেজোয়ানুল হকের অপারেশন করবো। উনাকে যখন অজ্ঞান করা হল তখন আমি নিজের কস্টিউম পড়ছি। জুনিয়র ডাক্তার কে দিয়েই এগুলো করাই আমি। আমি শুধু গিয়ে কাটাকাটির কাজ টা করি। সেদিন ও জুনিয়র তিনজন ডাক্তার মিলে সব প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা সেরে আমাকে কল দিল। আমি ও গেলাম। আর গিয়েই শুরু করলাম অপারেশন। ওপেন হার্ট সার্জারি ছিল সেটা।আমি যখন সব কেটে কুটে মাত্র হার্ট টাকে দেখতে লাগলাম এমন সময় আমার চোখ গেল ওটি রুমের বাম কোনায়। সেখানে আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে সেই বৃদ্ধ। আমি দেখে চোখের পলক ফেলতেই দেখি উনি নেই। হ্যালুসিনেশন মনে করে আবার অপারেশন শুরু করলাম।রেজোয়ানুল হকের হার্ট এর নিলয় এর দুটো শিরায় চর্বি জমেছিল। আমি সেগুলো পরিষ্কার করতে করতে হটাত করে কানের কাছে একটা কাশির শব্দ শুনলাম। প্রথমে পাত্তা দিলাম না। কারন এইখানে কোন ভুল হলেই রোগী মারা যাবেন। আমার কোন রকম ভুলের কারনে এতবড় মানুষ টার মৃত্যু হবে ভেবে আমি আবার মনযোগ দিলাম। কিন্তু আবার কাশিরশব্দ আসল। কাশিটা আসছিল বাম দিক থেকে। আমি বামে মাথা ঘুরিয়ে দেখি বৃদ্ধ হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঠোট নাড়ার আগেই বলে ঊঠল – “বাবাজি তুমি তো উনাকে বাঁচাতে পারবানা” আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি আকাশ পাতাল চিন্তা করে চলেছি। একজন মৃত মানুষ কিভাবে আমার পাশে এসে দাড়াতে পারে সেটাই মাথায় আসছিল না। আমি কোন উত্তর দেবার আগেই সেই লোকটি বলল- “ কি বুঝতে পারছো নাতো? শোনো- আমি জানি তুমি অনেক চেষ্টা করবে উনাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু পারবেনা”- বলেই আবার হেসেদিল সাদা পাঞ্জাবি পড়া বৃদ্ধ। আমি বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। কি বলব বুঝতে পারছিনা। উনাকে কি বলবো বুঝতে বুঝতে কাটিয়ে দিলাম পাঁচ সেকেন্ড। তারপর আবার মনযোগ দিলাম অপারেশনে। রোগীর অপারেশন সাকসেস হল। আমি ও হাপ ছেড়েবাঁচলাম। সেলাই করে দিয়ে শেষ বার ড্রেস করতে দিয়ে আমি মাস্ক খুলতে যাব এমন সময় হটাত করে রোগীর পালস রেট গেল বেড়ে। মেশিন গুলো যেন চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। হটাত করে বুকের ভেতর ধপধপ করা শুরু করল। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে রোগীর প্রেশার দেখলাম- বেড়েই চলেছে প্রেশার। হটাত করে এই অবস্থা হবার কথা না। আমি কয়েকজন ডাক্তারকে বললাম প্রেশারের ইনজেকশন দিতে। ওরা সেটা দিতেই প্রেশার ডাউন হওয়া শুরু করল। কিন্তু আবার ও বিপত্তি। এবার প্রেশার কমতে লাগল। আমি আবার টেনশনে পড়ে গেলাম। কিন্তুকোনভাবেই কিছু করতে পারলাম না। রোগীর হার্ট বিট ভয়ানক ভাবে কমতে কমতে একেবারে শুন্য হয়ে গেল নিমিশে।
এবং আমি তাকিয়ে তাকিয়ে রেজোয়ানুল হকের মরে যাওয়া দেখলাম। প্রথম বার আমার সামনে এক রোগী বলে কয়ে মরে গেল- আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমি আমার রুমে এসে বসে পড়লাম। রাগে আমার গা জ্বলতে শুরু করল। নিজেকে অনেক অসহায় মনে হতে লাগল। পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় রেজোয়ানুল হকের পাশাপাশি আমার হতাশাগ্রস্থ মুখ ও প্রকাশিত হল। মিডিয়া এমন এক জিনিস- কাঊকে মাথায় তুলতে দেরী করেনা- কাউকে মাটিতে আছাড় মারতে ও দেরী করেনা। আমাকে ও মাটিতে নামিয়ে আনল ওরা। আমার বিরূদ্ধে হত্যা মামলা রজুকরা হল সেই নেতার দলের লোকজনের পক্ষ থেকে। কিন্তু সরকার আমার পাশে ছিল বলে মামলা ধোপে টেকেনি। টাকা পয়সা খাইয়ে পুলিশ আর আদালতের সবকটাকেকিনে নিয়েছিলাম। তারপর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমি ও ফিরে আসি বাস্তব জীবনে। রোগীদের সেবায় মনযোগ দেই। ছোটখাট অপারেশন এ যোগ যেই। এরপর আসতে আসতে আমার জীবন স্বাভাবিক হয়ে ঊঠে।কিন্তু এর ঠিক ছয় মাস পড়েই এই মহিলা ডাক্তার কে অপারেশনের দায়িত্ব পরে আমার উপর। আমি নিরুপায় ছিলাম। উনাকে আমি কর্মজীবনে শ্রদ্ধা করতাম। আমার শিক্ষিকা ছিলেন। উনার হার্টে ব্লক ধরা পড়াতে উনাকে অপারেশনের দায়িত্ব উনি নিজেই আমাকে দেন। খুব ছোট অপারেশন। হরহামেশাই এই ধরনের অপারেশন হত-এখন ও হয়। হার্টের যে ধমনী গুলো ব্লক হয়ে যায় সেগুলোতে রিং পড়ানোর কাজ। আমি প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তুরোগীর পীড়াপীড়ি তে রাজি হই। অপারেশন টেবিলের সামনে এসেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কারন সেখানে সেই দিনের মতই বাম কোনায় বসে ছিল সেই বৃদ্ধ। উনাকে দেখেই বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠে আমার। অজানা আশংকায় কেঁপে উঠে মন। কিন্তু বাধ্য হয়ে আমাকে অপারেশন করতে হয়। আমি ও শুরু করি। হার্টের ধমনী একটাতে রিং পড়ানো শেষ করে আরেকটা যখন ধরবো এমন সময় কানের কাছে ফিসফিস করে বৃদ্ধ সেই আগের মতই বলল- “বাবাজি- আজকা ও তুমি উনারে বাচাতি পারবানা” হাসি হাসি মুখের ভেতর যেন রাজ্যের ঘৃণা। আমি উনার চেহারার দিকে এক পলক তাকিয়েই আবার কাজ শুরু করলাম। কিন্তু রিং পড়াতে গিয়েই হটাত করে ভুল করে কেটে গেল ধমনী টা। গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু করল। নিরুপায় হয়ে তিন চার জন মিলে সেই রক্ত বন্ধ করেধমনী পরিষ্কার করে জোড়া লাগাতে বসল। আমি নিজেও হাত দিলাম। কিন্তু যা হবার তাই হল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে রোগীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেল। আমি রক্তের জন্য লোক পাঠালাম। কিন্তু সামান্য ও পজেটিভ রক্ত সেখানে ছিলনা। এতবড় একটা হাসপাতালে ও পজেটিভ রক্ত না পেয়ে সেই ডাক্তার আপা মারা গেলেন চোখের সামনে। আমার কিছু ই করার ছিলনা। এরপর একদম ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি। আমার পরিবার থেকে বিয়ে করার জন্য চাপ আসল। আমি ও বিয়ে করলাম। মিতি- আমার বৌ- লক্ষ্মী বৌ আমার। যাকে বলে একেবারেই আটপৌরে মেয়ে। বিয়ে হয়েছে আমাদের মাত্র তিন সপ্তাহ। এরমাঝেই আমাকে করেছে আপন।কিন্তু ভাগ্য সহায় না থাকলে যা হয়- বিয়ের তিন সপ্তাহের মাথায় ওর আব্দাররাখতে গেলাম কক্সবাজার এ।সেখানে প্রথম দিনেই একটা আছাড় খেল মিতি বাথরুমে। প্রথমে আমি তেমন কিছু না বলে পাত্তা না দিলে ও পরে বুঝতে পারি মিতির কোন একটা বিশেষ সমস্যা হয়েছে। তখনই আমি মিতিকে নিয়ে আসি ঢাকায়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানতে পারি মিতির মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছে আছাড়ের ফলে। খুব দ্রুত মিতিকে অপারেশন করাতে হবে। নিজের স্ত্রী বলে মিতির অপারেশন আমি করতে চাইনি। কিন্তু সেই মুহূর্তে সব ভাল ভাল সার্জন রা দেশের বাইরে থাকাতে আমাকেই দায়িত্ব নিতে হল। আমি ও মেনে নিলামঅর্পিত দায়িত্ব। আমি এখন বসে আছি মিতির রুমের সামনে। আরেকটু পর মিতির অপারেশন। আমি মিতিরদিকেই তাকিয়ে ছিলাম- কিন্তু হটাত করে চোখ গেল মিতির কেবিনের বাম কোনায়।সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে সেই বৃদ্ধ। জানিনা কি হবে আজকে। যে কোন ভাবে মিতিকে বাঁচাতেইহবে। কিন্তু আজরাইলের বেশে বৃদ্ধের মুচকি হাসি দেখে আমার আশার প্রদিপ নিভতে শুরু করে দিয়েছে…… (সমাপ্ত) লিখেছেন : নষ্ট কবি
ভৌতিক ধারাবাহিকঃ ভুতুরে বাড়ি
মোঃ জাবেদ ভুঁইয়া
||এক|| রাতটা ভিশন আঁধারে ।রাস্তাটা আরও অন্ধকার ।চারদিকে একটানা ঝিঝি পোকার ডাক আর খনে খনে পাখিদের চিত্‍কার রাতটাকে আর একটু বেশিভূতুরে করে তুলেছে যেন । এই অন্ধকার কালোময়তায় ঢাকা রাস্তাটা দিয়ে হাটছি আমরা দু বন্ধু ।আমি অভি আর বন্ধু শিলু । আমার হাতে একটা কালো ব্যাগ ।আর শিলুর হাতেকোন ব্যাগ নেই ।কারন আমি ওর বাড়িতেই যাচ্ছি ।ও এসেছে আমাকে নিতে । শিলুর ফোন পেয়েছিলাম সকল ১০টার দিকে ।ঘুম থেকেওঠে সদ্য দাঁত ব্রাশ করছিলাম আর মনে মনে গ্রীষ্মকালীন ছুটিটাকিভাবে কাটাব সে বিষয়ে একটা রুটিন গেথে নিচ্ছিলাম মগজে ।কিন্তু শিলুর একটা ফোনই সব ওলট পালট করে দিল ।সদ্য গুছিয়ে নেওয়া রুটিনটার আগা থেকে গোড়া সমস্তটায় পাল্টে গেল ।একদম ফরফরিয়ে । দ্রুত ব্যাগপত্র গুছিয়ে সেইযে ট্রেনে উঠলাম নাম রাত বারোটায় ।বাইরে বেরিয়ে শীতের চেয়েও আরও বেশি জমে গেলাম ।দেখলাম পুরো ষ্টেশনটা ফাকা ।শুধু এককোনে দাড়িয়ে আছে শিলু ।গাড়ি ঘোড়ার কোনছায়াও দেখলাম না আশেপাশে । :-কিরে ব্যাগ নিয়ে হাটতে কি অসুবিধা হচ্ছে ? একটাউচুমতো জায়গা পেরোতে গিয়ে আমার দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল শীলু । :-না বরং ভালোই লাগছে । আর ভাল যে লাগছে সেটা বুঝাতেই ব্যাগটা এক হাত থেকে অন্য হাতে স্থানান্তরিত করলাম আমি । দেখলাম শীলু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে । চলবে ----
ভৌতিক গল্প : বুড়ো ফ্র্যাঙ্ক ও আমি
মোঃ আনোয়ার হোসেন
স্কলারশিপটা খুব তাড়াহুড়া করেই হয়ে গিয়েছিল। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না বিলেত যাব কি যাব না। পরিবারের সবাই বলল এমন সুযোগ হাতছাড়া করাটা ঠিক হবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম স্কলারশিপটা এক্সেপ্ট করে ফেলার। প্রায় ষোল ঘন্টা জার্নি করে যখন হিথ্রো এয়ারপোর্টে এসে পৌছলাম তখন ভোর প্রায় পাঁচটা। এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করার জন্য ইউনিভার্সিটি থেকে যাকে পাঠানো হয়েছিলসে আমার পি,এইচ,ডি প্রফেসার ফ্র্যাঙ্ক গ্রীণ এর অধীঃনস্থ আরেক পি,এইচ,ডি স্টুডেন্ট। নাম ম্যাথিউ জেরী। বয়স ত্রিশকি বত্রিশ হবে। সুদর্শন যুবক। গাড়িতে জানতে পারলাম পার্টটাইমে পি,এইচ,ডি করবার সাথে সাথেসে ইউনিভার্সিটির স্টাফ হিসেবেও কাজ করছে আর তাই আমাকে রিসিভ করার দায়িত্বটি সে সেচ্ছায় গ্রহণ করে। আমার পি,এই্চ,ডি’র বিষয় হল চাইল্ড সাইকোলজি আর ম্যাথিউ পি,এইচ,ডি করছে ডিপেনডেন্ট এল্ডার’স সাইকোলজি নিয়ে। আমাদের দু’জনের বিষয়ে খানিকটা মিলও আছে বলা যেতে পারে। কারন বৃদ্ধ বয়সে মানুষেরমন অনেক সময় শিশু সুলভ আচরণ করে আর তাছাড়া তাঁর বিষয়টি সেইসব বৃদ্ধদের সাথে জড়িত যারা শেষ বয়সে তাদের সন্তান সন্ততির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, যেমনটি তাঁরা শিশুকালে নির্ভরশীল ছিলেন তাদের বাবা মা’র উপর। আর এই মিলের কারনেই হয়ত ম্যাথিঊ আমাকে রিসিভ করারব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিল। গাড়ি করে হোস্টেলে পৌছতেপ্রায় দু’ঘন্টা লেগে গেল। আমাকে আমার রুমের চাবি দিয়ে ম্যাথিউ চলে গেল, যাবার আগে বলে গেল প্রফেসর ফ্র্যাঙ্ক আজ বিকেলে আমার সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করতে আসবেন। আমি যেন বিকেলের আগেই ঘুম থেকে উঠে পরি। রুমে ঢুকে আমি সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল দুপুর তিনটার দিকে। এটা কি এখানকার বিকেল কিনা বুঝতেপারলাম না। আরেকটু ঘুমাতেইচ্ছা হচ্ছিল কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক আবার চলে আসেন কিনা তাই ভেবে আর ঘুমালাম না। আমি স্যুটকেস খুলে কাপড় গুছাতে শুরু করলাম এমন সময় দরজায় কে যেন ধাক্কা দিল। দরজা খুলে দেখলাম এক বৃদ্ধ হাসিমুখেদাঁড়িয়ে আছেন। ইনি ফ্র্যাঙ্ক হবার কথা না। কারন ফ্র্যাঙ্ক এর সাথে আমার যেসব ইমেইল আদান প্রদান হয়েছিল তাতে করে আমার অনুমান ফ্র্যাঙ্ক এরবয়স পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন হবে। আর এই বৃদ্ধের বয়স কম করে হলেও পঁচাত্তর। বৃদ্ধ হাসিমুখে আমার দিকেহাত বাড়িয়ে দিয়ে অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, হ্যালো জোবেইর ( জোবায়ের)। আই এমফ্র্যাঙ্ক! হাউ আর ইউ ডুইং? আমি তখন বুঝতে পারলাম ইনিই আমার প্রফেসার। জবাবে হাসিমুখে আমিও তাঁরদিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম।মনে মনে বললাম, তুই এই সময় এলি কেন বুড়ো? আমি তভেবেছিলাম আরেকটু পড় আসবি। বুড়ো যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারল। সে বলল, এম আই টু আরলি জোবেইর? আমি বললাম, নো নো ইটস অলরাইট। আমার অবশ্য তখন ইচ্ছা হচ্ছিল আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে, কিন্তু এটা ত আর প্রফেসর কে বুঝতে দেয়া যাবেনা। কারন এর হাতেই এখন আমার সব কিছু। বুড়ো চাইলে আমি পি,এইচ,ডি ডিগ্রী পেতেও পারি আবার না চাইলে আমাকে এম,ফিল ডিগ্রী দিয়েও ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। এরপর ফ্র্যাঙ্ক আমাকে অনুরোধের সুরে জিজ্ঞেস করে, খুব বেশী ক্লান্তবোধ না করলে তাঁর সাথে এখন বাহিরে গিয়ে এক কাপ কফি খেতে আমি আগ্রহী কিনা? যদিও আমার সেই মুহুর্তে বাহিরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিলনা কিন্তু আমি তাঁকে মুখের উপর নাও করতে পারলাম না। রুম থেকে বেরিয়ে আমরা দুজন নিচের কফি শপে গেলাম। সময়টা বিকেলের দিকে হওয়ায় কফিশপে বসবার জায়গা পেলাম না। কাগজের মগে কফি নিয়ে আমরা দুজন বাহিরে কোথাও বসার জায়গা খুঁজতে লাগলাম। সেদিন রবিবার হওয়ার কারনে বাহিরের বেঞ্চগুলাতেও ছিল ছাত্রছাত্রীদের ভীর। দু’টা সাইনবোর্ডে দেখতে পেলাম লেখা ‘সামনে চার্চ’ আর ‘সামনে পার্ক’। ফ্র্যাঙ্ক আমাকে পার্কে যাবার প্রস্তাব দিল। আমি ফ্র্যাঙ্ক এর সাথে কফিতে চুমুক দিয়ে পার্কের দিকেএগোতে থাকলাম। তখন সন্ধ্যা প্রায় হবে হবে করছিল। কফির সাথে আমার হঠাত সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা হল, তাই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম। আমার সিগারেট এর প্যাকেট বের করা দেখে ফ্র্যাঙ্ক কে কিছুটা বিরক্ত মনে হল, তাই প্যাকেট আবার পকেটে ভরে ফেললাম। তা দেখে ফ্র্যাঙ্ক ভদ্রতার খাতিরে বলল, তুমি চাইলে সিগারেট ধরাতে পার, তবে আমার সিগারেটের ধোঁয়ায় সমস্যা হয় বলে আমাকে একটু ক্ষমা করতে হবে। তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য পার্কে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারি, তুমি আস্তে ধীরে সিগারেট খেতে খেতে পার্কে আসতে পার। আমি এর জবাবে বিনয়ের সুরে বললাম, তার কোন প্রয়োজন নেই। আমি এমনিতেই খুব বেশী সিগারেটখাইনা। তাই এখন না খেলেও কোন অসুবিধা নেই। আমি আসলে তখন মিথ্যা বলেছিলাম কারন আমার দিনে প্রায় একটা প্যাকেট শেষ করতে হত। ফ্র্যাঙ্ক যেন আমার মিথ্যা ধরে ফেলে নিজ মনেই মিটি মিটি হাসছিল। তারপর অল্প কিছুদূর এগোনোর পর আমরা পার্কের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।ফ্র্যাঙ্ক এর আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল সে এখন আমাকে আমার রিসার্চ এর টপিক উপর ছোটখাট একটা লেকচার দেওয়ার চেষ্টা করবে। -আমি কি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি জোবেইর? -অবশ্যই ফ্র্যাঙ্ক। -তুমি এত দূর থেকে এখানে কেন পি,এইচ,ডি করতে এসেছ? এ প্রশ্নে আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করলাম। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক কে তা বুঝতে না দিয়ে বললাম, -আমি চাইল্ড সাইকোলজি নিয়ে খুব বেশী আগ্রহী বলেই এখানে এসেছি। সেটা আপনাকে আগেই বলেছি ইমেইলে। তাছাড়া উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য সবচেয়ে কাছের দেশ বলতে আমরা বিলেতকেই জানি। আমেরিকা তআরো অনেক দূরে। -আই সি। তোমার পুরা নাম তোজোবেইর বিন ইসলাম তাইনা? -হ্যাঁ। -তুমি কি ইসলাম ধর্মে পুরোপুরি বিশ্বাস কর? -হঠাত এ কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? -কেন জিজ্ঞেস করছি তা কাল জানতে পারবে। আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। ফ্র্যাঙ্ক এর এরুপ আচরণ আমার কাছে কিছুটা রুক্ষ্মমনে হয়েছিল। তবে তাঁর সাথে আমি কোন বাক বিতর্কে যেতে চাচ্ছিলাম না বলে জবাব দিলাম, -হ্যাঁ পুরোপুরি বিশ্বাস করি। ফ্র্যাঙ্ক তখন সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, তাহলে ত তোমারশয়তানকেও বিশ্বাস করা উচিত তাই না জোবেইর?
এর জবাবে আমি কি বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একবার মনে হচ্ছিল ফ্র্যাঙ্ক আমাকে কথার জালে ফাঁসিয়ে যাচাই করে দেখতে চাচ্ছে আমি কতটা আধুনিক আর তাঁর অধীনে পি,এইচ,ডি করার উপযুক্ত কিনা। তাই আমি বললাম, আমি আসলে এইসব ব্যাপার নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। তবে আমি ভূত টুতে বিশ্বাস করি না। ফ্র্যাঙ্ক তখন কিছুটারেগে গিয়ে বলল, আমি কিন্তু ভূতের কথা বলিনি জোবেইর। আমি শয়তানের কথাবলেছি। শয়তান আর ভূত এক জিনিস নয়। আমি তখন প্রসংগ পাল্টাবারজন্য হাসিমুখে বললাম, দেখুন একটু পরেই সন্ধ্যা হবে, আমি আসলে এই মুহুর্তেএই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি না। আমি একটু ভীতু টাইপের। একথা বলে নিজেই হাসতে শুরু করলাম। ফ্র্যাঙ্ক আমার হাসি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে জিজ্ঞেস করল, -তুমি কি জানো তোমার এই স্কলারশিপটা তুমি এত তাড়াহুড়ো করে কেন পেয়েছ? এখনত ফেব্রুয়ারী মাস। এ মাসে ত সেশান শুরু হয় না। সেশান শুরু হয় সেপ্টম্বরমাসে। -সেশান কোন মাসে শুরু হয় তা আমার জানা নেই। কিন্তু আপনারাই ত আমাকে এখন আসতে বলেছেন। - তোমাকে আসতে বলা হয়েছে কারন তুমি যেই বিষয় নিয়ে গবেষনা করতে যাচ্ছ তা নিয়ে আগে গবেষনা করেছিল ভারতীয় এক ছাত্র।সে হিন্দু ছিল বলে শয়তানে বিশ্বাস করত না। তাই সে তাঁর গবেষনা সম্পূর্ন করতে পারেনি। ফ্র্যাঙ্ক এর এমন অদ্ভুত কথায় তখন আমার কিছুটা মেজাজ খারাপ হল। আমি কিছুটা বিরক্ত হয়েই ফ্র্যাঙ্ককে জিজ্ঞেস করলাম, -কি হাস্যকর কথা বলছেন আপনি। শয়তান এর সাথে আমার রিসার্চের সম্পর্ক কি? -তাও কাল জানতে পারবে। তবে এখন শুধু জেনে রাখ ‘ভাসকার’ কখনোই আমাকে বিশ্বাস করেনি। কারন সে ছিল ভারতের গোল্ড মেডেলধারী একজন স্কলার। আমি অনেকভাবেই তাঁর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সে আমার অস্তিত্ব অগ্রাহ্য করেছিল। আর তাই পরে তাকে আমি পাগল বানিয়ে দিয়েছি। সে এখন আছে আগ্রার পাগলা গারদে। আমার কেন জানি তখন খুব ভয়করতে শুরু করল আর মনে হতে লাগল ফ্র্যাঙ্ক যা বলছে তা সব সত্যি। আর যদি সত্যিহয় তাহলে এটা আমার সেই প্রফেসর ফ্র্যাঙ্ক না। এটা অন্য কেউ। একথা মনে করার পর আমি আর ভয়ে কোন কথা বলতে পারলাম না। ফ্র্যাঙ্ক আপন মনে বলে গেল, -দেখ জোবেইর তুমি নিজেই জান এ ধরনের স্কলারশিপ পাওয়া তোমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। তুমিবাংলাদেশের সাধারন একজন স্কলার। তোমার মাস্টার্সের রেজাল্ট তেমন ভাল ছিলনা। শুধুমাত্র অনার্সে তুমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলে। তাই ফ্র্যাঙ্ক তোমাকে ভাসকার এর পুরা ঘটনাটা গোপন করে ইমেইল করেছিল স্কলারশিপের অফার দিয়ে, যেন তুমি সহজেই তা গ্রহন কর। এতে ভাসকার এর করা অসমাপ্ত রিসার্চ সম্পূর্ণ হবে আর ফ্র্যাঙ্ক এর অধীনেও আরেকজন স্কলারের নাম যুক্ত হবে। ফ্র্যাঙ্ক ভাসকার এর কথাটা গোপন করেছিল কারন কোন ভাল স্কলার অন্যের করা রিসার্চ থেকে পি,এইচ,ডি’র রিসার্চ কখনোই শুরু করতে চাইবে না। তাই সে তোমাকে বেছে নিয়েছিল। আর এখন যদি তুমি আমার কথা না শুন তাহলে কিন্তু তোমার অবস্থা ভাসকার এর চেয়েও করুন হবে কারন তুমি আমাকে বিশ্বাস কর। আর বিশ্বাস কর বলেই তোমার স্নায়বিক চাপের উপর তোমার কোন নিয়ন্ত্রন থাকবে না। হয়ত এদেশের শীতল মাটিতেইতোমাকে সারাজীবন ঘুমিয়ে থাকতে হবে। ফ্র্যাঙ্ক এর কথা শেষ হবার সাথে সাথেই হঠাত চার্চের ঘন্টা বাজতে শুরুকরল। সন্ধ্যা তখন পুরোপুরি হয়ে এসেছে। আশেপাশে আবছা অন্ধকার। ফ্র্যাঙ্ক এবার আমাকে কিছুটা ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করল, চুপ করে আছ কেন? বল তুমি কি আমার অস্তিত্বের প্রমাণ চাও? আমি কিছুটা সাহস নিয়েই বললাম, হ্যাঁ চাই। আমার জবাব শুনে ফ্র্যাঙ্করাগে ফোস্ ফোস্ করতে শুরু করল। এক পর্যায়ে প্রচন্ডরেগে গিয়ে সে বেঞ্চ থেকে উঠে দাড়াল আর পার্কের ঘাসে শিশুদের মত হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করল। খুবই অদ্ভুদভাবে লক্ষ্য করলাম ফ্র্যাঙ্ক এর হাত পা আর মাথা পুড়ে কাল হয়ে গেছে, শুধু পরনেরপোশাকটা অক্ষুন্ন আছে। ফ্র্যাঙ্ক এর তখন মুখমন্ডল বলে কিছু ছিল না। যা ছিল তাকে শুধুমাত্র মাংসপিন্ড বলা চলে। তবে চোখের জায়গাতে বড় কাল দু’টি গর্ত হয়ে আছে। ফ্র্যাঙ্ক তখন পাঁচ-ছয় বছর বয়েসী শিশুদের মত গলায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই দুষ্ট লোকটা আমাকে চুলোর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর চুলার সুইচ অন করে দিয়ে আমায় অনেক্ষন শক্ত করে ধরে রাখল। তারপর আমাকে বলল লাইটার জ্বালাতে। আমিযেই লাইটার জ্বালালাম আর অমনি আমার সারা শরীরে আগুন ধরে গেল। তারপর থেকে আমি ওইখানে একা একা শুয়ে থাকি। আমাকে আমার আম্মুর কাছে নিয়ে চলো। একথা শুনার পর আমি পাশে তাকিয়ে ভাল করে দেখার চেষ্টা করলাম। অন্ধকারের জন্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবে বুঝতে পারলাম পার্কের পাশেই একটা কবরস্থান রয়েছে। এরপর আমি ভয়ে বুকের মাঝে প্রচন্ড চাপ অনুভব করতে শুরু করলাম। আমি তখন ভয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। সম্ভবত আমি সেখানেই জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরে পাবার পর জানতে পারলাম আমি গত রাতে পার্কের বেঞ্চের কাছে পরেছিলাম। চার্চের পাদ্রীরা সন্ধ্যায় প্রার্থনা সেরে পার্কের ভিতর দিয়ে যাবার সময় আমাকে পরে থাকতে দেখে আর ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে আসে। পরে ফ্র্যাঙ্ক এর সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখলাম ফ্র্যাঙ্ক এর চেহারা অবিকল গতকালের সেইবুড়োর মত কিন্তু বয়স ঠিকই পঞ্চাশের ঘরে। আমি ফ্র্যাঙ্ক কে সব ঘটনা খুলে বললাম। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক আমার কোন কথাই বিশ্বাস করল না। বরং মনে করল আমি আমার পরিবার থেকে এতদূর এসে একাকিত্ববোধ করছি বলে এখন দেশে যাবার বাহানা করছি। ফ্র্যাঙ্ক কে ভাসকার এর কথা জিজ্ঞেস করায় সে ভাসকার এর পাগল হয়ে যাবার কথা স্বীকার করল এবং সে যে ভাসকার এর ঘটনা টা গোপন করেছিল তাঁর জন্য তাকে কিছুটা লজ্জিতওমনে হল। কিন্তু আমি কিভাবে ভাসকার এর কথা জানলাম সেই যুক্তি দিতে চাইলে সে সেটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা জানা কোন বড় ব্যাপার নয়। হয়ত হোস্টেলের কারো কাছ থেকে জেনেছি কিংবা ম্যাথিউই আমাকে বলেছে। এ নিয়ে ফ্র্যাঙ্ক এর সাথে আমার তীব্র বাক বিতন্ড লেগে যেতে শুরু করেছিল, আমি তখনসিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফিরে যাব। শেষে ম্যাথিউর সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ করলাম আমাকে একটা প্লেনেরটিকেট কিনে দেবার ব্যাবস্থা করে দিতে।
ম্যাথিউ সানন্দে আমার অনুরোধে রাজি হল এবং নিজে ড্রাইভ করে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌছে দিল। গাড়িতে যাবার সময় শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল ফ্র্যাঙ্ক সেজে যে আমার কাছে এসেছিল সে বুড়োর বেশ ধরেছিল কেন? কিন্তু কোনভাবেই কোন যুক্তি খুঁজে বের করতে পারলাম না। গাড়ি থেকে নামবার সময় ম্যাথিউ আমাকে জিজ্ঞেস করল আমাকে ভিতরে এগিয়ে দিবে কিনা। আমি বললাম না থাক দরকার নেই। এই বলে তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করতে যাব এমন সময় খেয়াল করলাম ম্যাথিউ অদ্ভুত ভংগিতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।সে তখন অবিকল সেই বুড়োর মত গলা করে বলল, তোমাকেও আমায় বিশ্বাস করবার জন্যধন্যবাদ।
আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ভুতুরে গল্প
শাহিন কাদের
এটি একটি সত্যি ঘটনা যা বছর চারেক আগে আমার সাথে ঘটেছিলো।। সে রাতে আমি আমার গ্রামের বাড়ি চট্রগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে ফিরছিলাম।। প্রায় ঘণ্টা তিনেক একটানাগাড়ি চালিয়ে কিছুটা ক্লান্ত ছিলাম।। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার চিন্তায় একমুহূর্তের জন্যও অসতর্ক হই নি।। রাত তখন প্রায় ২ টার মতো বাজে।। এতো রাতে ঢাকায় ফেরার মূল কারন হল, তারপরের দিন সকাল ১০ টায় আমার অফিসে একটা জরুরী মিটিং আছে।। যাই হোক, আসারপথে খাজা বাবার মাজার নামে একটা জায়গা পড়ে।। সেই জায়গা নিয়ে অনেক কুসংস্কার রয়েছে, যে সেখানে নাকি প্রচুর পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটে।। চালক প্রায়ই গাড়ির ব্যাল্যান্ স হারিয়ে ফেলে,অথবা ব্রেক জ্যাম হয়ে যায়ইত্যাদি ইত্যাদি।। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা ছিল।। শুধুমাত্র রাস্তায় কিছু ট্রাক আর গুটিকয়েক প্রাইভেট কার।। আমি আনুমানিক ৭০-৮০ কিমি বেগে গাড়ি ছুটাচ্ছিলা ম।। রাস্তার উপর তীক্ষ্ণ নজর।। হটাত একটা মোড় ঘোরার সময় আচমকা দেখলাম একটা লোক রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।। লোকটার পড়নে একটা ছেড়া ফাটা হাফ প্যান্ট।। গায়ে কোনো কাপড়নেই।। মুখে জঙ্গলের মতো দাড়ি।। চোখগুলো আলো পড়ে ঝিকঝিক করছে।। হলদে দাঁতগুলো দেখে অন্য সময় হয়তো ঘেন্না লাগতো।। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার গাড়ি তার গায়ে আঘাত করবে অথচ মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার গাড়ির দিকে।। ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম।। ব্রেকচেপে ধরবো যে, সেই চিন্তাওতখন মাথায় আসছিলো না।। সত্যি করে বলতে গেলে, যেই স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছিলা ম,সেই স্পীডে ব্রেক করলেও তা ঐ লোকটাকে সজোরে ধাক্কা দিবে।। নিজেকে ফিরে পেলাম হটাত।। প্রানপ্রনে ব্রেক চেপে ধরলাম।। কিন্তু শেষ রক্ষাহলো না।। গাড়িটি হেঁচড়ে যেতে লাগলো লোকটির দিকে!! একদম শেষ মুহূর্তে চোখটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেলো।।আশা করছিলাম, গগন বিদারি কোনো চিৎকার শুনবো, কিন্তু অবাক করে দিয়ে কানে এলো কেউ যেনও পাগলেরমতো হেসে উঠলো।। আমার গাড়ি লোকটাকে বেধ করে চলে গেলো।। বেধ করে বলছি কারন, আঘাতের কোনো শব্দ আমি পাই নি।। যাই হোক, সজোরে ব্রেক চাপায় গাড়িটি ২০-২৫ মিটার সামনেগিয়ে থেমে গেলো।। দ্রুত দরজা খুলে বের হলাম।। আশ্চর্য, এতক্ষণ রাস্তায় অনেক গাড়িকেই সাইড কাটিয়েছি।। অনেক গাড়িই আমাকে পাশ করে সামনে এসেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে যতদূর দৃষ্টি যায় কোনো গাড়ি দেখতে পাচ্ছি না।। যাই হোক, এতো কিছু ভাবার মতো শক্তি তখনছিল না।। প্রায় দৌড়ে সেই জায়গায় এলাম যেখানে লোকটিকে দেখতে পেয়েছিলাম। । কিন্তু, এসে কাউকে দেখলাম না।। ভাবলামধাক্কা খেয়ে হয়তো ছিটকে দূরে গিয়ে পড়েছে।। প্রায় মিনিট দশেক আঁতিপাঁতি করেখুজলাম।। কিছুই দেখলাম না।। আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে রাস্তাটা নির্জনই রইলো।। একটা গাড়ি দেখলাম না।। একরকম অমানুষিক কষ্ট উপলদ্ধি করলাম মনের ভেতর।। একটা মানুষকে মেরেফেলেছি!! সে রাতে বহু কষ্টে গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম। । অফিসের মিটিংটা জয়েন করে এরপর একসপ্তাহের ছুটি নেই।। আমারঢাকার বাসায় আমি এবং আমারওয়াইফ থাকতাম।। তাকে কিছুবলিনি।। পাছে, ভয় পায় বা আমাকে খারাপ ভাবে।। আমার আচার আচরণ দেখে আমারওয়াইফের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগলো।। এদিকে আমিমোটামুটি শপথ করেছি যে তাকে কিছু বলবো না।। যাই হোক, আমার ওয়াইফের পিড়াপীড়িতে পড়ে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম আবার দেশের বাড়িতে যাবো।। সেদিন শকালেই আবারো চট্রগ্রামে র উদ্দেশে রওনা হই আমরা।। এবার আমারবউ ছিল সাথে।। দেশের বাড়িতে আমরা ২দিন ছিলাম।। হটাত একদিন বিকেলে ফোন এলো অফিস থেকে।। কিছু বিদেশী ক্লায়েন্ট এসেছে।। আমার উপস্থিতি খুব করে দরকার।।আমার ছুটির তখনো ২দিন বাকি।। তাই প্রথমে আমার বউ খুব করে আপত্তি জানালো।। কিন্তু, তাকে বুঝিয়ে বলতে সে মেনে নিলো।। বুঝতে এবং বুঝাতে ভালোই সময় ব্যায় হলো।। সেদিন রাত ১১টার দিকে পুনরায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই আমরা।। এদিন আমি গাড়ি খুব ধীরে চালাচ্ছিলা ম।। স্পীড কোনো অবস্থাতেই ৪০-৫০ এর বেশি উঠাচ্ছিলাম না।। আমিগাড়ি চালাচ্ছি।। আমার বউ পাশে বসে গান শুনছে।। আস্তে আস্তে আবারো সেই রাস্তায় চলে এলাম, যেখানে গতদিন এক্সসিডেন্ টটা করেছিলাম!! খারাপ লাগা ভাবটা ফিরে এলো আবার।। রাস্তার উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছি।। হটাত আমাকে চমকে দিয়ে রাস্তার ঠিক ঐখানটায়আজকেও ঐ লোকটিকে দেখতে পেলাম।। সাথে সাথে আমার বউকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, সে কি কিছু দেখতে পাচ্ছে কিনা!! গান শুনতে থাকলেও তার চোখ খোলা ছিল।। আমি ধাক্কা দিতেই কান থেকে হেডফোন নামিয়ে বলল, “আশ্চর্য!! এই লোক হটাত করে কোত্থেকে উদয় হলো!!” আমার আর প্রশ্ন করা লাগলোনা।। যা জিজ্ঞেস করতে নিয়েছিলাম তার উত্তর এমনিতেই পেয়ে গেলাম।। ব্রেক করে গাড়ি থামালাম।। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, গাড়ি থামানোর সাথে সাথে লোকটা যেনো হাওয়ায় মিলিয়েগেলো।। আমার বউয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও নিজেও ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে।। ভয় সতন্ত্র গলায় বলল, “লোকটা কোনদিকে গেলো??” আমার কাছে কোনো উত্তর ছিলনা।। শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম খোলা রাস্তার দিকে।