সম্পূর্ন বাংলা হরর ম্যাগাজিন
|||মাসিক ভৌতিক |||
সেপ্টেম্বর ২০১১ইং সংখ্যা ।
সংখ্যা নং ১
আমাদের কথা
সুপ্রিয় হরর গল্প প্রিয় বন্ধুগন , শরতের এই মনমাতানো দিনে তোমাদের কাছে এবার নিয়ে এলাম এক অনন্য সুখবর ।তা হল এবার [সেপ্টেম্বর ২০১১] প্রথম বারের মত প্রকাশিত হচ্ছে Uhtml ফরম্যাটের মোবাইল বই ম্যাগাজিন 'মাসিক ভৌতিক' ।যা অনলাইনেও পড়া যাবে।আশা করি এবারের গল্প গুলো আপনাদের অনেক অনেক ভাল লাগবে ।আর একটি কথা ।আমাদের দ্বিতীয় সংখ্যা অক্টোবর ২০১১ এর জন্য লেখা পাঠিয়ে দাও jabed.bhoiyan@gmail.com এই ঠিকানায় । আমাদের পরিচিতিঃ সম্পাদকঃ মোঃ জাবেদ ভুঁইয়া কম্পোজারঃ সাইফুল মোল্লা [মোল্লা ডিজিটাল স্টুডিও] উপদেষ্টাঃ ইমরান ভুঁইয়া পরামর্শঃ আকাশ ভুঁইয়া । প্রকাশিতঃ প্রভাতী অনলাইন প্রকাশনা কর্তৃক ।
লাল চোখ
কবির মুকুল আহমদ
রাত দশটা খড়মপাড়া গ্রামের জন্য বেশ অনেকই রাত। ফইজু মেম্বার ভাবে নাই কাজ শেষ করতে করতে এতরাত হয়ে যাবে। কিন্তু এই এলাকার মাতবর সে। চেয়ারম্যান থাকে সদরে। তাই গ্রামের বিচার আচার আর শালিশ-দরবার সব ফইজু মিঞাকেই সমলাতে হয়। দেখা যায় দরবার শেষ হয়ে গেলেও অনেকে ঘিরে ধরে তাকে, মিষ্টি পিচ্ছিল কথা বলে। তো আজকেও এমনি একটা বিচারছিল। প্রবাসী শ্রমিক মনির হোসেনের স্ত্রী বেলায়াতীর সাথে প্রতিবেশী আছির মন্ডলের একটা গোপন কচলাকচলি দেখে ফেলে ভাতৃবধু সুফিয়া। তারপর হাকডাক, কান্নাকাটি আর ঝগড়া-ঝাটির পর আজকের এই শালিস। এরই মধ্যে ফইজু মিঞার সমবয়সী আছির মন্ডল তলে তলে রসময় সমঝোতায় চলেআসে তার সাথে। শালিস শেষেবেলায়েতীর সাবিত্রী রায় নিয়ে জনসমাগম বাড়ী চলে যায়। আর সাঝবেলা আধো আলো আঁধারে কি দেখতে কি দেখা আর সেটা নিয়ে হাক ডাক করার জন্য তিরস্কৃত হয় সুফিয়া। তারও আধা ঘন্টা পর ফইজু মিঞা বুঝতে পারে আসলেই বেলায়াতী বেশ উদার। তার বাধানো তাগড়া শরীরেও হাপ ধরে গিয়েছে একদ্রুত আপ্যায়নে। কাজ কাম শেষে বাড়ীর পথ ধরে ফইজু মিঞা। ফটফটে জোৎøা আছে, গ্রাম্য পথ চলতে তেমন কোন সমস্যাই হচ্ছিল না। নিথর গভীর রাত, নুন্যতম শব্দহীন সুনসান চরাচর। তেল মারা বয়সী হারকিউলিস সাইকেল প্যাডেলে প্যাডেলে সামান্য কোঁকিয়ে উঠছে শুধু। ফজিুর সারা শরীরে একটা আরামদায়ক অবসাদ। তবে, নাপাক শরীরে একটু অস্বস্তি লাগছে। কারন গায়েবী মাখলুকাতগুলো নাপাক শরীরের গন্ধ পায়, একা পেলে যা তা উৎপাত করে। কার্তিকের মাঝরাত। ঝলক ঝলক হিমেল হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে মাঝে মধ্যে। হঠাৎ একটা কালো বিড়াল হুস করে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়ে পারহয়ে গেলো। আর একটু হলে সাইকেলের নীচে চাপা পড়তো। ফইজু মিঞা থামে। লুঙ্গীর কোট থেকে বিড়ি ম্যাচ বের করে আগুন জ্বালায়। কষিয়ে টান বসায়। কেমন যেন একটা অব্যক্ত অস্বস্তি ফুটে উঠছে মনের পটে। নাহ্! এত রাতে এমন একা একা বের হওয়া ঠিক হয় নি। আবজইল্ল্যা আসতে চেয়ে ছিল সাথে। কিন্তু সাইকেলে ডাবলিং করার হ্যাপায় তাকে ফিরিয়ে দিয়ে ছিল ফইজু। এখন সামান্য আফসোস হচ্ছে। কেমন যেন একটা বোবা ভয় ধীরে ধীরে কুয়াশার মত দলাপাকাচ্ছে অসম সাহসী ফইজু মিঞার গোটা অস্তিত্বকে কেন্দ্র করে। পল পল করে পার হয় কিছু বোবা সময়। উষ্ণ ঘাম বুক গলা ভিজিয়ে দিচ্ছে তার। একটা দিশেহারা ভাব তাকে যখন গ্রাস করতে যাচ্ছিল ঠিক তখন দূর থেকে ভেসে আসলো কয়েকজন মানুষের কন্ঠস্বর। উঠে দাঁড়িয়ে পাছায় ঘাম ভেজা করতল মোছেফইজু। অবারিত জোৎøায় চোখসরু করে তাকায়। তিনজন ছেলে বয়সী মানুষ আসছে। হঠাৎ যেন কর্পূরের মত উবেগেল সব ভয়। জাদরেলী হাঁক ছাড়লো, ‘ কারা যায়’? কাছে এসে পাশের গ্রামের যুবকত্রয়ের সলাজ উত্তর, বাজারের ভিডিও দোকানে রাতের বিদেশী ফিলিম দেখে বাড়ী ফিরছে তারা। ফইজু মিঞা সাইকেল ঠেলে হাটতে থাকলো তাদের সাথে। বেশ অনেকটা পথ এক সাথে যাওয়া যাবে। সংকোচিত যুবকদের বিদেশী ফিলিম দেখার কুফল বর্ণনা করতে করতে দিঘীর পাড়ে পৌছে গেল। এবার যুবকত্রয় ভিন্ন পথে যাবে। ফইজু মিঞার বাড়ী এখান থেকে আর মাইলখানেক মাত্র। চলে যাওয়া যাবে একটানে। বিদায় নিল যুবকেরা। তারা চোখের আড়ালে যেতেই আবার স্বমহিমায় ফিরে এল সেই পুরাতন ভয়। যেন কাছাকাছি কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল এতণ। নিরিবিলি পেয়ে লাফিয়ে চেপে বসেছে ফইজু মিঞার ঘাড়ে। বাতাসে হাত চালিয়ে কি যেনউড়িয়ে দিয়ে আবার রওনা হল দোটানায় পড়া ফইজু। দিঘীর উঁচু পাড় থেকে নিচে নেমে গেছে রাস্তাটা। অনেক দূর পর্যন্ত প্যাডেল মারতে হয় না। শুধু হ্যান্ডেল ধরে বসে থাকলেই হয়। জোরে জোরে কয়েকটি চাপ দিয়ে পা দুটোকে জিরাতে দিল ফইজু। ঝড়ের বেগে সা সা করে ছুটেচলছে সাইকেল। আরো কিছু বাড়তি গতি দিতে সজোরে প্যাডেল দাবায় ফইজু। হঠাৎ আবিস্কার করে চেইন পড়ে গেছে। হতাশ হয়ে সাইকেল থেকে নামে সে। মনের মধ্যে কেমন যেন কু ডাকছে। বোধ হচ্ছে সাইকেল থেকে নামাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু কি আর করা। না, চেইনটা পড়েনি! মাঝ বরাবর দুই খন্ড হয়ে ছিঁড়ে গেছে! বাকীটা পথ সাইকেল ঠেলে নিয়ে যেতে হবে। দিঘী পাড়ে রাস্তার দুপাশে যেমন ঘন ছনের ঝোপ ছিল, এখানটা একদম পরিস্কার। সামনের দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় ধূ ধূ চরাচর। হাশেম মুন্সীর পাথার। এই বিস্তীর্ণ পাথারের পরই শুরু হয়েছে ফইজুদের গ্রাম। গ্রামের একেবারে মাঝামাঝিতে তার বাড়ী । কিছু দূর যাবার পর ফইজু মিঞা দেখলো মেটে রাস্তার উত্তর পাশে বেশ কয়েকজন মানুষ বসে আছে। আরো একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল দশ-বারো জন যুবক বয়সী ছেলে রাস্তার পাশে বসে দুলে দুলে কি যেন বই পড়ছে। পরনে লম্বা সাদা জামা আর মাথায় গোল টুপি। চারপাশটা কেমন যেন একটা লালাচে আভায় আলোকিত হয়ে আছে। এই কটকটে জ্যোৎøায় চেষ্টা করলে হয়তো কিছু পড়া যায় কিন্তু এতো জায়গাথাকতে রাস্তায় বসে পড়াশুনা করতে দেখে ফইজুর মেজাজ তিরিি হয়ে উঠলো। ‘কে রে তোমরা, এখানে কি কর’? পিলে চমকানো হাঁক দাগালো ফইজু মিঞা। সবগুলো যুবক শান্তভাবে এক সাথে তাকালো ফইজু মিঞার দিকে। হঠাৎ অন্তরাত্বা খাঁচা ছাড়া হয়ে গেল ফইজু মিঞার।
যুবকগুলোর চোখের জায়গায় যেন গনগনে অঙ্গার বসানো। ধক্ব ধক্ব করে জ্বলছে। লাল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে চারপাশ। কেমন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। পড়া বন্ধকরে ধীরগতিতে নড়ে উঠে যুবকেরা। যেন তার অপোতেই বসে ছিল এতো সময়। বিস্ফোরিত চোখে ফইজু দেখে চার হাত পায়ে ভর করেদ্রুতগতিতে তার দিকেই ছুটে আসছে তারা। ওওওরে.... বাবা গো......! বলে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় দিল ফইজু মিঞা। ঢেলায় আঘাত খেয়ে পায়ের নখ উল্টে গেছে, কাদায় পিছলা খেয়ে লুঙ্গী ছিড়ে গেছে, কোন অনুভূতি নেই ফইজুর। যে কোন মূহুর্তে যেন ফেটে যাবে ফুসফুস। বাড়ীর পেছনের ডেঙ্গা দিয়ে ট্টটি ও মুরগীর ঘরের ফাঁকগলে দাওয়ায় আছড়ে পড়ে সে। গোঁ গোঁ শব্দ করে হঠাৎ নীথর হয়ে যায় সে। বাড়ীর লোকজন কুপি হারিকেন নিয়ে বের হয়ে এসেদেখে চিৎ হয়ে পড়ে আছে নিস্পন্দন ফইজু মিঞার প্রাণহীন দেহ। চোখ দুটো আর দাতের পাটিগুলো বিস্ফোরিত ভাবে খুলে আছে। দাঁতের ফাক গলে বের হয়ে আছে লম্বাটে শুষ্ক জিহবা। মারা গেছে ফইজু মিঞা। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আলগা বাতাস লাগা লাশ। কান্নার রোল উঠলো ফইজুর বউ আর বাধা মুনীদেরমাঝে। আর্তনাদে যেন চিরে দুই ভাগ হয়ে যাবে কালো আকাশ। হিম শীতল দেহটাকে গোসল করালো পড়শীরা। নিঃসন্তানফইজু মিঞার জন্য বিলাপ করার জন্য আধবুড়ো বউ ছাড়াআর তেমন কেউ নেই। বউও মূর্চ্ছা খেয়ে পড়ে আছে। তার শুশ্র“সা করছে পাড়ার নারীরা। সিদ্ধান্ত হলো আলগা লাগা মরা গোর দিতে দেরী করা যাবে না। রাত পোহালেই ফজরের নামাজ শেষে জানাজা দিয়ে দেয়া হবে। ফজরের নামাজ শেষ পর্যায়ে লম্বা সালাম দিয়ে ডানে বামে ঘাড় ঘোরালেন ঈমাম সাহেব। মুসল্লীরা অবাক হয়ে দেখলেন জামাতে শরীক হয়েছে অপরিচিত দশ-বারো জন যুবক বয়সী তালিবুল এলেম। তাদের আচার আচরনে কেমন যেন অদ্ভুত একটা মিল। সবাই যেন একজন কিংবাএকজনেরই প্রতিচ্ছায়া সবাই। এপাড়া বা আশেপাশের গ্রামের নয় এটা নিশ্চিত। কারন, এই এলাকার মানুষেরাএমন তুষার সফেদ কুর্তা গায়ে দেয় না। এবার জানাজা নামাজ। এক কাতারে পাশাপাশি দাঁড়িয়েনামাজ পড়লো যুবকেরা। জানাজা শেষে অন্যদের একরকম জোর করে সরিয়ে দিয়েই লাশের খাটিয়া কাঁধে তুলে নিল চার যুবক।তারপর হন হন করে হাঁটা ধরলো গোরস্থানের দিকে। অন্ধকার ভোরে কোন মুসল্লীই তাদের গতির সাথে তাল মেলাতে পারছে না। মসজিদের বয়স্ক ঈমাম আর হাফেজ মুয়াজ্জিন কিছু একটা সন্দেহ করতে লাগলো। কিন্তু সবকিছু বুঝে উঠার আগে হামিদার ছাড়া বাড়ীর মোড় ঘুরেই যেন শুণ্যে মিলিয়ে গেল লাশের খাটিয়া আর তার বাহকেরা। কোথাও দেখা গেল না তাদের। শুধু চারপাশ ম ম করছে আতর আর লোবান পোড়া গন্ধে। ফইজু মিঞার লাশ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি।
নিথর
কবিরনি
১ রাত দুইটা বাজে। এবার উঠতে হবে। টাইড খেলা অনেক হয়েছে। আর ভাল লাগছে না। যদিও তাসের এই পর্ব সারারাতই চলবে। মামুন বিদায় নিল। বন্ধুরা নাছড় বান্দা। কেউ ছাড়তে চাই না। চাদঁ রাত বলে কথা। সারারাত ক্লাবে হই হুল্লর। আজ আবার একটা ছাগল চুরি করা হয়েছে। রান্না ভাল হয়নি। কেমন একটা বমি বমি লাগছে। মামুন ঢাকায় থাকে। ঈদের সময় শুধু বাড়ি আসা। চাদঁ রাতে পাড়ার এই ক্লাবটির চেহেরায় বদলে যায়। প্রায় সব বন্ধু ই জড়ো হয়। এবার শুধু নয়ন নেই। ডিভি পেয়ে আমেরিকা চলে গেছে। নয়নের উদ্দেশ্যে শোকগাথাঁ লেখা হয়েছে। কাশেম লিখেছে। কবি হিসাবে এই মফস্সল শহরে তার আবার খানিক নাম ডাক আছে। ভোর চারটায় আরেকবার গলা ভেজানোর ব্যবস্থা আছে। মামুনের মন ক’দিন ধরে এমনিতেই খারাপ। বিয়ের পর রুমা’কে ছাড়া প্রথম ঈদ করছে। মামুন শত প্রলোভন উপেক্ষা করে বেড়িয়ে পড়ল। শরিরটা আসলেই খারাপ করেছে। মাথার ভিতর একটা ভোতাঁ যন্ত্রনা। ক্লাব থেকে বেরিয়ে বাড়ির সর্টকার্ট পথ ধরল। ধানক্ষেতের আল দিয়ে। রাত ভালই হয়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইলে চার্জ নেই। অনভস্ত্যতায় পথ চলতেএকটু কষ্টই হচ্ছে। হঠ্যাৎকরে বমি চলে এসেছে। আর আটকাতে পারল না। ধান ক্ষেতের পাশেই বসে পড়ল। মনে হচ্ছে আর দাড়াতে পারবে না। আশেপাশে কাউকে খোজাঁর চেষ্টা করল। কেউ কি আছে। অন্ধকারে ভাল করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এখনো অনেক পথ। একটু পানি পেলে ভাল লাগত। কুলি করা দরকার। ঠিক এসময় নিমাই দা এসে উপস্থিত : কিরে, মামুন না। কি হয়েছে তোর। : নিমাই দা। খুব খারাপ লাগছে : দাড়া। আমাকে ধরে দাড়া। : মনে হয় পারব না। একটু পানি খাওয়াতে পারবে। : পানি নেই। ধর স্প্রাইট খা। : দেও। মামুন স্প্রাইট দিয়েই কুলকুচি করল। আরেকবার বমিহয়ে গেল। : নিমাই দা, আমাকে একটু বাসায় দিয়ে আসবা। : শোন আমার বাসাতো কাছেই। তুই চল। আগে কিছুক্ষন রেস্ট নিবি। ২ মামুন বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিল। নিমাই দা স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের অংকের মাষ্টার। মামুনদের দু-ব্যাচ সিনিয়ার। অসম্ভব ভাল। কিছু মানুষ থাকে উপকার করার জন্য জন্মায় সেই টাইপের। মামুন নিমাই এর হাত ধরে উঠে দাড়াল। দু-জনেই নিরবে এগিয়ে চলছে। গুনগুন করে নিমাই দা কি যেন একটা গাইছে। মামুনের তখন শোনার মত অবস্থা নেই। হঠ্যাৎ নিমাইদা মামুনের হাত শক্ত করে ধরল। : কি হয়েছে? : সামনে দেখ। সামনে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কাফনেরকাপড় পড়ে পাচঁটা লাশ পড়ে আছে ধান ক্ষেতের উপর। হালকা নড়ছেও। ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল কেন জানি। : চল : কি ওগুলো : চল না। যেয়ে দেখি। : যাবা : দুর গাধা। তুইতো ভয়েই আধমরা হয়ে গেলি। : আমিতো এমনিতেই আধঁমরা। কিছু দেখলে কিন্তু ফুল মরা হয়ে যাব। : বকবক করিস না। চল কিছু দুর যেয়েই ঘটনা পরিস্কার হল। ধান ক্ষেতেরউপর কে যেন কাপড় শোকাতে দিয়েছে। সাদা কাপড়। সেগুলোই দূর থেকে লাশের মত লাগছে। দু-দজনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি। নিমাইদা’র গানটা এবার বোঝা যাচ্ছে। নজরুল সংগীত। শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে শাওন রাতে যদি…. ভুলিও স্মৃতি মম নিশীথ স্বপন সম আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ পরে বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে শাওন রাতে যদি…. ৩ মামুন শুয়ে আছে নিমাই দা’রবাড়িতে। বাসা পর্যন্ত যেতে পারে নি। নিমাই দা’র বাড়ির সামনে আরেকবার বমি।কিছুতেই নিমাই দা ছাড়ল না। একটা এভোমিন পাওয়া গেছে। বৌদিও খুব ভাল। সাক্ষাত প্রতিমা’র মত চেহারা। মামুনের বিছানা গুছিয়ে দিল। বেশি কথা না বাড়িয়ে মামুন চুপচাপ শুয়েপড়ল। ছোট্ট একটা বাড়ী নিমাই দা দের। তিন রুমের। উপরে টিন। নিমাই দা বৌদি’ পাশের রুমে। বাসায় বোধহয়আর কেউ নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিমাই দা’র একটা ছোট বোন ছিল। রাজশ্রী। মামুনের সাথে একটা অনৈতিকসম্পর্কও কিভাবে যেন গড়ে উঠেছিল যৌবনের প্রথম বছরে। বেশি দূর আর এগোয়নি। মামুন ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ে চলে এল। পরের বার গিয়ে শোনে বিয়ে হয়ে গেছে। সে অনেক দিন হল।শুনেছি এখন তিন ছেলে মেয়ের মা।মামুন রাজশ্রীর চেহারাটা মনে করা চেষ্টা করছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। আর দু-চোখ খোলা রাখা যাচ্ছে না। কখন ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই। হঠ্যাৎ ঘুম ভেঙে গেছে। অদ্ভুত একটা শব্দে। মনে হচ্ছে এ ঘরে কোন মহিলা নামাজ পড়ছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে নামাজ পড়ার সময় যেমন আওয়াজ হয় সেরকম আওয়াজ। মামুন চোখ বন্ধ করে ফেলল। মনে মনে বলার চেষ্টা করল সে ভুল শুনেছে। গাছের শব্দ হতে পারে। কিছুক্ষন পর আর আওয়াজ পাওয়া গেল না। চোখ খুলে আরেক বিষ্ময়। নিমাই দা দের ঘরে টাঙিয়ে রাখা কৃষ্ঞ এর ছবিটা যেন মামুনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মামুন চোখ বন্ধ করে ব্যাখ্যা দ্বার করাবার চেষ্টা করল। দূরের কোন আলো জানলা দিয়ে ছবির উপর পড়ে এমন হতে পারে। ঠিক তাই। নিজের আহাম্মকিতে নিজেই হাসার পালা। ঘুমানো’র চেষ্টা করছে কিন্তু ঘুম আসছে না। একটা’র পর ভুতের গল্প মনে পড়ছে। মামুন রুমা’র কথা মনে করার চেষ্টা করল।
৪ অনেকক্ষন ধরে রোদে দাঁড়িয়ে আছে। ঘামে একাকার। একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু লাইন ছেড়ে যাওয়া যাবে না। বিডিআর দের একদল রিলিফ দিচ্ছে লা্ইন এদিক ওদিক হলেই লাঠির বাড়ি। মামুন রিলিফ নেওয়ার জন্য লাইনে দাড়ায়নি। পুরো ব্যবস্থাটা সরেজমিনে প্রতক্ষ করছে নিছক কৌতুহলে। অসহায় মানুষদের কষ্ট উপলদ্ধির ব্যর্থ চেষ্টা। ভদ্রলোকের মুখোস পড়ে আতলামী আর কি? মামুনের সঙ্গে কামাল ভাই।একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছেন ক’দিন ধরে। একটা পত্রিকায় কাজ করেন। তার সঙ্গেই আসা। পরীক্ষা দিয়েকি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এ সময় দেশ জুড়ে ঝড়ের ভয়াল থাবা। ঘূর্ণিঝড়ে বিধস্ত এলাকা পরির্দশনের কৌতুহল আর কামাল ভাই যাচ্ছে তার সঙ্গি হওয়াতে কৈশর থেকেই রোমান্চ অনুভব করা। কিন্তু রোদের দাপটে আর টিকতে পারল না। সরে আসতে হল। ভরপেট খেয়েও দাড়াতে পারল না আর না খাওয়া লোকগুলো কিভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে আছে ভাবতেই অবাক হতে হয়।গত কয়েকদিন দেখেছে মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম। বেচেঁ থাকা কত কষ্টকর তবু কি আশায় যেন বেঁচে থাকে মানুষ। স্বপ্ন প্রতারিত তবু স্বপ্ন দেখে বারবার। পথের এক কোণে একটি চায়ের দোকান দিয়ে বসেছে এক বুড়ো চাচা। কাষ্টমার নেইবললেই চলে। জনাকয়েক সাংবাদিক আর রিলিফ দিতে আসা মামুনে’র বয়সী কিছু ছেলে মেয়ে আছে। চা খাব। পিরিচে না ঢেলে চা খেতে পারে না সে। একটা মেয়ে খুবকৌতুহল নিয়ে মামুনের ফু দিয়ে চা খাওয়া দেখছে। মামুন তাকে কিছুটা অবাক করে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞাসাকরল : ভালো আছেন? অবাক হয়ে মামুনের দিকে তাকিয়ে সীমাহিন চেষ্টা স্মরন করার। মামুনই আবার কথা বলে উঠল - : আপনি ঢাকা থেকে আসছেন। : জি। কিন্তু আপনাকে তো… : চিনতে পারলেন না। তাই তো। আমিও পারিনি। চা এর বিল মিটিয়ে সোজা হাটা ধরে মামুন। পিছনের দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে। জানে অবাক বিস্ময়ের এক জোড়া চোখ নিরীক্ষন করছে। সেই প্রথমরুমা’র সাথে দেখা। ৫ মেঘের দিকে তাকিয়ে ছবি কল্পনা করা মামুনের ছোট বেলার অভ্যাস। পাবলিক লাইব্রেরীর চত্তরে বসে সেই চেষ্টায় করছিল। এমন সময় প্রশ্ন - : কেমন আছেন। অবাক হবার পালা। সেই মেয়েটি। যেন মামুনকে জব্দকরার জন্যই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। : আপনি ঢাকাতেই থাকেন। আগের সেই কথোপকথনের প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা বোধহয়। : আপনি : কি চিনতে পারেন নি। আমি কিন্তু ঠিকই চিনেছি। : আমিও চিনেছি। কিন্তু একটু অবাক হয়েছি আপনাকে দেখে। : আপনি তো অবাক করে দিতে ভালবাসেন। তা নিজে অবাক হয়ে কেমন লাগছে। মামুন হাসল। সে হাসিই যেন মামুন আর রুমা’র সম্পর্কটাকে আরও অনেক দূরনিয়ে চলল। পরিচয় থেকে আস্তে আস্তে ভাব ভালবাসায়গড়াল ব্যাপারটা। মনের রঙিন ঘুরি উড়িয়ে দিল এই যান্ত্রিক নগড়ে। সব কোলাহোল ছাড়িয়ে নির্জন নিরিবিলিতে প্রেম করতে করতে একদিন রুমা’র সাথে বিয়ে হয়ে গেল।আসলে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে এমন কিছুই ছিল না দুজনের ভিতর।সে পারিবারিক হোক আর সামাজীক। তাই খুব সহজেই ওরা একে অপরের কাছে আসতে পেরেছিল। বাসর রাতে হৈমন্তীতে পড়া সেই কথাটা নাড়া দিয়ে গেল – “পাইলাম”। ৬ রুমা আর মামুনের সম্পর্কটা বন্ধুর মত। একেবারে তুই সর্ম্পক। ভালোবাসার কমতি পরিলক্ষিত হয়নি কখনো কোথাও। ঢাকা শহরে একটা ছোট্ট ফ্লাটে থা্কে। একটা কাজের মেয়ে দেশের বাড়ী থেকেই এসেছে। ভালই চলছিল। খুনসুটি ঝগড়া ঝাটিযে একেবারে হত না তা না। তবে সাময়িক। সকাল ৭টার মধ্যে মামুনকে বেড়িয়ে পড়তে হয়। সারাদিন গার্মেন্টেস এ থাকে। ঢাকাশহরের জ্যাম ঠেলতে ঠেলতে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯ টা। অফিসের আশেপাশে বাসা নিয়ে লাভ নেই। কারন অফিসে তার কোন কাজ নেই। যখন যে গার্মেন্টস এ কাজ চলে সেখানেই ডিউটি। রুমা’র একাক্বিত্ব ঘোচানের চেষ্টার কমতি নেই মামুনে’র। টি.ভি তো আছেই সাথে একটা নেট এর লাইন সহ একটা পি.সি কিনে দিয়েছে। শিখিয়ে দিয়েছে হাতে ধরে ব্যবহার। কিন্তু এই নেট লাইন ই একদিন দুই জনের নিবিড় সর্ম্পকে হঠ্যাৎ কেন যে ফাটল ধরাল তা বুঝে উঠতে পারল না। আসলে দোষটা কার কোথায় কতটুকুসে প্রশ্নে কোনদিনই একমতহতে পারেনি। প্রথম প্রথম নেট এ রুমা কি করে না করে খুব আগ্রহ ভরে মামুনকে দেখাতো। কিন্তু তারপর কোথায় যেন একটা গোপনীয়তা। লুকোচুরি খেলা। কিছু বিশেষ লোকের সাথে আলাপ চারিতায় বারবারমানা করা সত্বেও মামুন আবিষ্কার করে কি নেশায় আড্ডায় বুদ হয়ে থাকে সে। ভয়ঙ্কার কিছু হলেও হতে পারে ছা’পোষা মানুষ মামুন প্রশয় দিতে পারে না।নিজের মনটা’র ভিতর অশুভ চিন্তা বয়ে যায়। নারীর অধিকারের প্রশ্নে বড় বড় বুলি আউরানো এই মামুনই নিজেকে আবিষ্কার করে পৃথিবীর রঙ্গমন্চে অভিনেতা হিসাবে। এক কথা দু কথায় তর্ক। থামতে চাই না। বহু ব্যবহার করা তর্কের মূহৃতে বুকের ভিতরজড়িয়ে ধরে ঠোটের আলতো স্পর্শ মেখে দিয়া ঠোটে ওষুধটাও ইদানিং আর কাজ করে না। ঝগড়া চলতেই থাকে ভোর রাত অবধি - : এটা কি হলো? : ভালোবাসা। : এ সব ন্যাকামী আমার সাথেআর করবা না। : আচ্ছা করব না একটু হাস। : ধ্যাৎ, ছাড় না, ছাই? : ছাড়ব না।কি করবি? : উফ। অসহ্য। রুমা রেগে উঠে চলে যায়। অনেকক্ষন কোন খোজঁ নেই।মামুন পিছু পিছু যেয়ে দেখি সেই নেট। মেজাজ তিরিক্ষি হয়। সব ভালবাসাকে অপমান করে গায়েহাত তুলে ফেলে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রুমা। দুচোখ বেয়ে নেমে আসতে থাকে জল। লজ্জায় সে জল মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে সামনে থেকে দ্রুত উঠে গিয়ে বেডরুমে ভিতর থেকে দরজায় সিটকিনি দেই। কিংকতর্ব্যবিমুঢ় হয়ে বসে থাকে মামুন।
৭ পরদিন অফিস থেকে ফিরে রুমা’কে আর বাসায় দেখতে পাই না। ফুলির হাতে ছোট্ট একটা চিরকুট ধরিয়েদিয়ে গেছে - : “চললাম। সন্দেহ করে ভালবাসাকে অপমান করেছ। আমার একাকিত্বকে ঘোচাতে না পেরে সহজাত পুরুষালী স্বভাব দেখিয়েছ। তোমার কাছ থেকে আমার আশা অনেক বেশী ছিল। আর দশ জনের সাথেতোমার পার্থক্য ঘুচিয়ে দিলে।ভাল থেকো।” তারপর প্রায়ই একমাস হত চলল। রুমা বাপের বাড়ী থেকে আসে নি। মামুন একাই ঈদ করতে চলে এসেছে গ্রামের বাড়ী। এই মধ্যরাতে ভয় তাড়াবার জন্যএসব যখন ভাবছে মামুন ঠিক তখনই ভূমিকম্প হল। প্রথম দফা’য় তাই মনে হয়েছে। কিন্তু চোখ খোলার আগেই মনে হল পুরো খাট ধরে কেউ যেন ঝাকি দিচ্ছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। ভীষন ভয় লাগছে। কোন ব্যাখা দাড় করাতে পারছে না। কলেমা মনে করার চেষ্টা করতে লাগল প্রান পনে। এতে ভয় দূর হয়। কিছুতেই মনে পড়ছে না। এ সময় গগন বিদারি একটাচিৎকার ভেসে এল। কোন পিচাশের পক্ষেই এরকম আওয়াজ করা সম্ভব। মামুন লাফ মেরে উঠল। নিমাই দা নিমাই দা বলে প্রান পনে চিল্লাতে লাগল। কোন সাড়াশব্দ নেই। দরজা খুলে বাইরে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু দরজা খুলতেই যে দৃশ্য দেখল তাতে আত্বারামখাচাঁ হবার যোগাড়। বৌদি দাড়িয়ে আছে। সিনেমায় দেখারক্তচোষা ড্রাকুলাদের মত লাগছে। দাতে রক্ত লেগে আছে। সারা শরিরে রক্ত। কুৎসিত শব্দ করছে। কাচাঁ মাঙসের গন্ধ এসে নাকে লাগল। সামনে নিমাই দা’র লাশ পড়ে আছে। সেখান থেকে কলিজা বের করে খাচ্ছিল বোধহয়। ওফ এত বিভৎস! থুথু না বমি যেন করল বৌদি।গলা মাংস আর কলিজা বের হয়েআসছে মুখ দিয়ে। মামুন স্থির। মামুনের দিকে এগিয়ে আসছে নর খাদকটা। নখ গুলো বেশ বড় বড়। মামুন ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইল। কিন্তু একেবারে নিখুত কাজ। সোজা মামুনের গলায় দাতঁ বসে গেছে। অজগরের খড়গোশ ধরার মত মামুনকে জাপটে ধরে রক্ত চুষতে লাগল। মামুনের দেহ নিথর। শেষবারের মত রুমা’র মুখটা মনে পড়ছে। পাদটীকা. মামুনের লাশ পাওয়া গেল পরদিন সকালে ঝিলের ধারে। নিমাই সরকার প্রথম দেখে। পরে সবাইকে খবর দেয়। পুলিশি তদন্ত চলছে। কি হয়েছিল ঠিক কেউ বলতে পারে না। তবে মামুনের গলায় দুটো ফুটো ছিল এটা নিশ্চিত।
ভৌতিক গল্প : থাবা
অনীশ দাস অপু
‘অনেকদিন আগে বরিশালেরবাবুগঞ্জ থানার দেহেরগতি নামে ছোট একটি গাঁয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এক দানব। দানবটাকে কেউ দেখেনি। শুধু তার অস্তিত্বের প্রমাণ ছিল নির্মম শিকারের বলি হওয়া গ্রামবাসী।’ একইভাবে খুন হয়ে যেত সবাই- প্রত্যেকের ঘাড়ে থাবার চিহ্ন। দানব দশটা নখ বসিয়ে দিতো শিকারের ঘাড়ে। শুরুতে মানুষ নয়, ছোটখাট প্রাণী দানবটির শিকার হচ্ছিল। একদিন সকালে এক কৃষক ঘুম থেকে উঠে দেখে তার তিনটা ছাগল রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়েরয়েছে। এরপরে গাঁয়ের তিনটে পোষা কুকুরকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সবার ঘাড়ে অদ্ভুত থাবার চিহ্ন। গুজব ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। প্রাণীগুলোর অন্তিমদশার কথা জানে সবাই। কিন্তু কেউ বলতে পারে না কীভাবে মারা গেল জানোয়ারগুলো। একটি বাছুরও রক্তক্ষরণে মারা গেল। নিরীহ প্রাণীটির ঘাড়ে শিরা টেনেছিঁড়ে ফেলা হয়েছে দশ আঙুলে। ঘাড়ে দশটি ধারাল নখের চিহ্ন। এরপর সাবধান হয়ে গেল গ্রামবাসী। বিছানার পাশে দা-কুড়াল-খন্তা রেখে তারা ঘুমাতে লাগল। গোয়াল ঘরে তালা মেরে রাখা হলো পোষা জন্তুদের। গোটা গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। নানানজনে নানান গল্প বানাতে লাগলো। একে অন্যের দিকে তারা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। এরপরে ঘটল সেই ঘটনা-যে ভয়টা এতদিন সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। দানব হামলাচালালো মানুষের ওপর। আক্রমণের শিকার হলো মাতালজমির উদ্দিন। একদিন সকালেমৃত অবস্থায় পাওয়া গেল তাকে। ঘাড়ে দশটা নখ বসানোচিহ্ন। গর্ত হয়ে আছে। কুকুর, ছাগল এবং বাছুরের মত একই পরিণতি হয়েছে তার।প্রবল রক্তক্ষরণে মারা গেছে। তিন কুলে যার কেউ নেই সেই ভবঘুরে জমির উদ্দিনের মৃত্যুতে গাঁয়ের মানুষ শোক প্রকাশ করলো না, তবে ভয়ে কলজে শুকিয়ে গেল সবার। কারণ সবাই জেনে গেছে মানুষ শিকারেও অরুচি নেই দানবের। যে কেউ তার শিকারহতে পারে। ভীত-সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীএবারে গড়ে তুললো একটি স্বেচ্ছাসেবী দল। তারা রাতের বেলা পালা করে গ্রাম পাহারা দেবে। তবে মুশকিল হলো কেউ জানে না কীসের বিরুদ্ধে তারা লড়াইকরছে। লিটু আর টিটু নামে দুই ভাইকে করা হলো সেচ্ছাসেবী দলের নেতা। এরা গাঁয়ের সবচেয়ে সাহসী দুই তরুণ। একমাত্র এদের বাড়িতেই দু’টি বন্দুক আছে। বন্দুক দিয়ে তারা মাঝে মাঝে গাঁয়ের পাশের জঙ্গলে শিকার করে। আর এদের বাড়ি জঙ্গলের ধারেই।এবং লোকের ধারণা দানবটা জঙ্গলেই আস্তানা গেড়েছে। ওদের বাছুরটাকেই মেরে ফেলেছে দানব। সেচ্ছাসেবী দল গঠন হওয়ার পরে লিটু-টিটু বাড়ি গেল কীভাবে রাতে পাহারা দেবে তা নিয়ে আলোচনা করতে। শীতের রাত। তাই রান্নাঘরেউনুন জ্বেলে বসলো দুই ভাই। ওদের মা নেই। বাবা আছে। আর বুড়ি দাদী। দাদী প্রায় বেশিরভাগ সময় চুলোরপাশে বসে থাকে গায়ে কালো একটা চাদর জড়িয়ে। উনুনের উত্তাপে শরীর গরম রাখে। ‘আজ রাত থেকেই শুরু পাহারা,’ নিচু গলায় বলল বড়ভাই লিটু। ‘দলনেতা হিসেবে আমাদের ওপর এ দায়িত্ব বর্তেছে। তা ছাড়া অন্যরা এখনই পাহারায় যেতে ভয় পাচ্ছে।’ ‘হুঁ,’ সায় দিল ছোট ভাই টিটু। ‘ওটা-যাই হোক না কেন-প্রতি পাঁচদিন পরপর হামলা চালায়। জমির উদ্দিনমারা গেছে আজ পাঁচদিন হলো। আজ রাতে আবার ওটা হামলা চালাতে পারে। কাজেইআজই পাহারা বসাতে হবে।’ ‘তোরা পাহারা দিতে যাচ্ছিস যা,’ বলে উঠলো ওদের বাবা। ‘তবে কিসের সঙ্গে টক্কর দিবি সে কথা মনে থাকে যেন। ওটা কিন্তু আকস্মিক হামলা চালায়। এ পর্যন্ত যে ক’টা হামলা হয়েছে, ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কাজেই খুব সাবধান। আম্মা, আপনি কি বলেন ? চুলোর পাশে বসা দাদী তাঁরছেলের দিকে একবার চোখ তুলে চাইলেন। কেন জানি শিউরে উঠলেন। তারপর আবার মুখ নামিয়ে তাকিয়ে রইলেন জ্বলন্ত চুল্লির দিকে। ওরা তিনজন নিজেদের আলোচনায় ফিরে গেল। বুড়ির কাছ থেকে অবশ্য কোনও জবাবআশাও করেনি। কারণ দাদী স্বল্পবাক মানুষ। তা ছাড়াবেশ ক’বছর ধরে তাঁর মাথারওঠিক নেই। হঠাৎ হঠাৎ উল্টোপাল্টা সব কাজ করে বসেন। লিটু তাদের পরিকল্পনার কথা জানালো বাবাকে। ‘আমি আর টিটু আজ রাতে বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে যাব। তবে জঙ্গলে ঢুকব না। জঙ্গল আরগাঁয়ের মাঝখানের রাস্তায় পাহারা দেব। দানবটা যদি আসেই আমাদের চোখ এড়িয়ে গাঁয়ে ঢুকতে পারবে না।’ ‘তোরা পাহারা দিবি কিভাবে?’ জানতে চাইল উদ্বিগ্ন বাবা। ‘আমরা একজন আরেকজনের ওপর নজর রাখব,’ জবাব দিল লিটু।‘হাঁক-চিৎকার দিলে শোনা যায় এরকম দূরত্বে থাকব দু’জন। জঙ্গলের দিকে চোখ থাকবে আমাদের। দানব যদি সত্যি জঙ্গলে থাকে, বেরুনো মাত্র ওকে গুলি করব।’ ‘কাউকে না কাউকে তো কাজটা করতেই হবে.’ টিটু বললো তারবাবাকে। ‘জানি না দানবের পরবর্তী শিকার কে হবে, তবেহাত-পা গুটিয়ে অসহায়ের মতো আর বসে থাকা যায় না।’ বাবা মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দুই ছেলেকে জড়িয়েধরলো বুকে। ‘বেঁচে বর্তে ফিরে আসিস, বাপ।’ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল সে। লিটু দেয়ালে ঝোলানো বন্দুক জোড়া নামাল। টিটু কাঠের সিন্দুক খুলে ধারালদু’টি রাম দা বের করল। একটা দিল বড় ভাইকে। নিজেরকাছে রাখল অন্যটা। তারপর দাদীকে সালাম করে বেরিয়ে পড়ল দু’জনে। বাইরে ঘোর অন্ধকার। পশ্চিমাকাশে কাস্তের মত একফালি বাঁকানো চাঁদ। পুবর্দিকে পা বাড়াল দুই ভাই। ওদিকেই জঙ্গল। ওরা যেখানটাতে পাহারায় দাঁড়াবে ভেবেছে, কাছাকাছিআসতে ফিসফিস করল টিটু, ‘ভাবছি ওটা দেখতে কেমন।’ ‘আমিও একই কথা ভাবছি, ‘বলল লিটু। ‘হয়তো কোনও দানব পাখি-টাখি হবে। সাঁৎ করে আকাশ থেকে নেমে এসে ঘাড়েরশিরা ছিঁড়ে পালিয়ে যায়।’ দু’জনেই আকাশে তাকাল। পাতলা, সরু চাঁদটিকে ঘিরে আছে মেঘ। আকাশ থেকে কিচু উড়ে এলেও আঁধারে ঠাহর করাযাবে না।
‘ওটা মাটির নিচের কোনও প্রাণীও হতে পারে,’ মৃদু গলায় মন্ত্রব্য করল টিটু।‘মাটিতে গর্ত খুঁড়ে থাকে। সুযোগ বুঝে হামলা চালিয়ে বসে পেছন থেকে।’ ছোটভাইয়ের কথা শুনে গা কেমন ছমছম করে ওঠে বড়ভাইয়ের। পেছন ফিরে তাকায় সে। দেখাদেখি টিটুও। কিন্তু নিকষ আঁধারে কিছুই দেখা যায় না। অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল দুই ভাই। শেষে নীরবতা ভাঙল লিটু। ‘চল, যে যার জায়াগায় গিয়ে দাঁড়াই। তবে বেশিদূর যাসনে। হাঁক ছাড়লেই যেন সাড়া পাই।’ দু’ভাই দু’দিকে চললো। লম্বা লম্বা চল্লিশ কদম ফেলে দাঁড়িয়ে পড়ল। অন্ধকারে বন্দুকে গুলি ভরল লিটু। তারপর রামদা’টা নরম মাটিতে পুঁতল। রামদা’র পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। চল্লিশ কদম দূরে, অন্ধকারে ভীত ভঙ্গিতে বন্দুকে হাত বুলাচ্ছে টিটু। তার হাত কাঁপছে। এতদিন জঙ্গলে খরগোশ, বুন বেড়াল এবং বন মোরগ ছাড়া কিছু শিকার করেনি। সাহস বলে যতই নাম-ডাক থাকুক, ভূতের ভয় তার বেজায়। স্রেফ লজ্জায় না বলতে পারেনি। বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে পাহারায়। দানবটা ভূত-প্রেত হতে পারে। নইলেতাকে কেউ এতদিন দেখতে পায়নি কেন? ভূতের বিরুদ্ধে কি বন্দুক দিয়ে লড়াই করা চলে? আর ওটা যদি ভূত না-ও হয়, ভয়ঙ্কর কোনও জন্তুও হয়, প্রয়োজনের সময় বন্দুক চালাতে পারবে তো সে? বড় ভাইকে দেখতে খুব ইচ্ছে করল লিটুর। কিন্তু ঝোপ এবং গাছের গাঢ় ছায়া যেন গিলে খেয়েছে লিটুকে। দেখা যাচ্ছে না। ঘুরলো টিটু। তাকালো গাঁয়ের দিকে। ইস্, কেন যে মরতে মীটিং-এ সবার সামনে বড় বড় কথা বলেছিল। বাবার সামনেও হামবড়া ভাব দেখিয়েছে, যেন কিছু গ্রাহ্য করছে না। পেছনে টাশ্শ্ শব্দে একটা মরা ডাল ভাঙল। চরকির মত সরল টিটু। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না, আর কোনও শব্দও শোনা গেল না। পেশীতে ঢিল পড়ল টিটুর। বন্দুকের কুঁদো ঠেকাল মাটিতে, হেলান দিল। ঘুম ঘুম আসছে। আর ঠিক তখন ঘাড়ে সুচের মত তীক্ষ্ণ ব্যথা ফুটল। কেউ ওর গলায় ধারাল নখের থাবা বসিয়েছে। তীব্র, তীক্ষ্ণ আর্ত-চিৎকারে ভেঙে খানখান হয়ে গেল বনভূমির নিশি-নৈঃশব্দ্য। লাফিয়ে উঠল লিটু। ওর ভাইয়ের গলা না? এক হাতে বন্দুক, অপর হাতে রামদা নিয়ে চিৎকারেরউৎসের দিকে ছুটল ও। কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এমন সময় টিটুর ঘরঘরে গলা শুনতে পেল টিটু। গোঙাচ্ছে। গোঙানি লক্ষ্য করে ছুটল ও। আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল গোঙানি। ভাইকে দেখা যাচ্ছে না তবে ওর বেশ কাছে এসে পড়েছে লিটু বুঝতে পারছে। বন্দুকটা ফেলে দিল ও। অন্ধকারে গুলি করলে টিটুর গায়ে গুলি লাগতে পারে। দু’হাতে রামদা ধরে মাথার ওপর বনবনকরে দু’পাক ঘোরাল লিটু। কিছু একটার সঙ্গে বাড়ি খেল ধারাল ফলা। রক্ত জল করা একটা চিৎকার শুনল লিটু। গা হিম হয়ে গেল ওর। টিটুর লাগেনি তো? ও তো আর গোঙাচ্ছেও না। অন্ধকারে হয়তো রামদার কোপ ভাইয়ের গায়ে লেগেছে। মারা গেছে সে। বুক ফেটে কান্না এল লিটুর। এমন সময় আবার গোঙাতে শুরু করল টিটু। স্বস্তির পরশ ঝিরঝির করে নামল লিটুর শরীরে। নাহ্, ওর ভাই মারা যায়নি। হঠাৎ একটা শব্দ শুনতে পেললিটু। মরা পাতার ওপর দিয়েছুটে যাচ্ছে কিছু একটা খচমচ শব্দ তুলে। ধেড়ে ইঁদুর-টিদুর হবে হয়তো। তবে ওটাকে দেখতে পেল না লিটু। সে আন্দাজে ভাইয়ের পাশে এসে বসল। তখন মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ক্ষীণকায় চাঁদ। তার অতি অল্প আলোয় টিটুর দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল লিটু। টিটুর ঘাড়ে গেঁথে আছে চিমসানো একটা কাটা হাত। কাটা কনুই থেকে রক্ত ঝরছে। হাতটার আঙুলে বড় বড়ধারাল নখ। নখগুলো খামচে ধরে আছে টিটুর কাঁধসহ ঘাড়। অন্ধকারে রামদার পোপে এ হাতটাই কেটে ফেলেছে লিটু। সময় মত এসে পড়ায় রক্ষা পেয়েছে টিটু। কাটা হাতের মায়া ত্যাগ করেই পালাতে হয়েছে দানবকে। লিটু টিটুর ঘাড় থেকে টান মেরে ছুটিয়ে আনল কাটা হাত। নখের আঘাতে গর্ত হয়েগেছে ঘাড়ে। রক্ত ঝরছে। ক্ষতস্থানে রুমাল বেঁধে দিল লিটু। তারপর ভাইকে নিয়ে রওনা দিল গাঁয়ে। কাটা হাতটা পড়ে রইল জঙ্গলে। ওদের বাবা ভয়ার্ত শুকনো মুখে অপেক্ষা করছিল দোর গোড়ায়। ছোট ছেলের চিৎকার শুনতে পেয়েছে। দু’ছেলেই বেঁচে আছে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললো সে। টিটুকে খাটিয়ায় শুইয়ে দিলওরা। ডেটল আর পানি দিয়ে পরিস্কার করল ক্ষতচিহ্ন। আর কয়েক সেকেণ্ড দেরী করলেই খবর হয়ে যেত টিটুর।ওকে জ্যান্ত ফিরে পেত না লিটু। ভাইয়ের ঘাড়ে ব্যাণ্ডেজ করতে করতে দানবের কথা ভাবছিল লিটু। কাটা হাত নিয়ে রক্তক্ষরণেধুঁকতে ধুঁকতে জঙ্গলেই হয়তো মরে পড়ে থাকবে দানবটা। আহত টিটুকে নিয়ে লিটু এবংতার বাবা এত ব্যস্ত ছিল যে খেয়াল করেনি চুল্লির পাশে দাদী নেই। দাদী যে খিড়কির দরজা দিয়ে আবার রান্নাঘরে ঢুকেছেন তাও লক্ষ করেনি কেউ। দাদী কাঠের পিঁড়িতে বসে শীতল, ক্রুর চোখে দুই নাতির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কেউ শুনল না তাঁর অসংখ্য ভাঁজ পড়া মুখ থেকে হিসহিসশব্দ বেরিয়ে আসছে। এবং কেউ দেখল না কালো চাদরের নিচে তিনি রক্তাক্ত একটি মাংসপিণ্ড লুকিয়ে রেখেছেন।
হরর ধারাবাহিকঃ শিয়াল দেবতার প্রতিহিংসা ||প্রথম পর্ব

মূল : রবার্ট ব্লচ

রূপান্তর : অনীশ দাস অপু

অ্যানুবিসের বিশাল মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। ওর অন্ধ চোখ শতসহস্র বছরের অসীম আঁধার সয়ে আসছে, হাজার বছরের ধুলো জমেছে পাথুরে দৃষ্টিতে। গুহার স্যাঁতসেঁতে হাওয়া বিকট মূর্তির গায়ে সৃষ্টি করেছে কালের ক্ষত, তবে পাথরের ঠোঁট দুটোর পৈশাচিক হাসির ভয়াবহতাকে ম্লান করতে পারেনি একটুও।যেন জ্যান্ত দানব একটা। কিন্তু শেয়াল দেবতা অ্যানুবিস নিস্প্রাণ একটা পাথুরে মূর্তি ছাড়া কিছুই নয়। এই দেবতার যারাপূজা করত সেই পূজারীরা মরে কবে ভূত হয়ে গেছে। এই গুহার চারপাশে যেন মৃত্যুর ছায়া, এই ছায়া যেনঘুরে বেড়ায় অ্যানুবিসকে ঘিরে। ঘাপটি মেরে আছে মমির কফিনে, গা মিশিয়ে আছেশতাব্দী প্রাচীন মেঝের ধুলোর স্তূপে। মৃত্যু এবংঅন্ধকারের এই ভয়াল রাজ্যেআলোর প্রবেশ নিষেধ। গত তিন হাজার বছরের এখানে আলোর একটি রেখাও দেখা যায়নি। কিন্তু তিন হাজার বছর পর আজ দেখা গেলো। গুহাগুলোর শেষ মাথায় ঝনঝনশব্দ শোনা গেলো, কারা যেন ত্রিশ শতকের পুরোনো লোহারগেট খুলে ফেললো। তারপর খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রতিফলিত হলো মশালের আলো, এরপর ভেসে এলো মানুষের গলা। ব্যাপারটা রোমহর্ষক এবং অদ্ভুত। ুত। গত তিন হাজার বছরে এই কালো এবং ঘুটঘুটে অন্ধকার সমাধিস্তম্ভে আলোকরেখার কোনও প্রবেশ ঘটেনি। গত তিন হাজার বছরে ধুলোয় ধূসরিত মেঝেতে পড়েনি কারওপায়ের ছাপ। গত তিন হাজার বছরে এই গুহার প্রাচীন বাতাস বয়ে আনেনি কোনও মনুষ্য কণ্ঠ। এই গুহার শেষ আলোকরেখা বিচ্ছুরিত হয়েছিলো বাস্ত-এর সন্ন্যাসীর হাতের মশাল থেকে; ধুলোয় শেষ পায়ের ছাপ পড়েছিলো মিসরীয়দের; শেষ কণ্ঠটি শোনা গিয়েছিলোনীলনদের এক পূজারীর। কিন্তু আজ, হঠাৎই গুহামুখ আলোকিত হয়ে উঠেছে বৈদ্যুতিক মশালের আলোয়, মেঝেয় বুট জুতোর শব্দ আর বাতাসে পুরুষালি ইংরেজ কণ্ঠ। মশালের আলোয় মশালবাহীরচেহারা দেখা গেলো। মানুষটি লম্বা, রোগা। বাঁ হাতে ধরা পার্চমেন্ট কাগজের মতোই তাঁর চেহারায়বয়সের রেখা সুস্পষ্ট। ভদ্রলোকের মাথার চুল যেন কাশফুল, কোটরাগত চোখ আর হলদেটে ত্বক তাঁকে বুড়ো মানুষের কাতারে ফেললেও ঠোঁটে ঝুলে থাকা হাসিতে মালিন্য নেই একবিন্দু, যুবকের আত্মপ্রত্যয় এবং দৃঢ়সংকল্প যেন ধারণ করে আছে ওই হাসি। তাঁর ঠিক পেছনেই এক তরুণ, হুবহু বৃদ্ধের চেহারা। বোঝাই যায় যুবক বৃদ্ধের সন্তান। ‘আমরা তা হলে ঠিক জায়গায় এসে পড়েছি!’ উত্তেজিত হয়ে বলল তরুণ। ‘হ্যাঁ, খোকা, এসেছি।’ হাসিমুখে জবাব দিলেন বাবা। ‘বাবা, দেখো! ওই যে সেই পাথরের মূর্তি। ম্যাপে যেটার নাম লেখা ছিলো!’ চলবে ....
অনুবাদিত ভৌতিকঃ একা কবরস্থানে

মূল : অ্যালভিন শোয়ার্জ

অনুবাদ : হাসান খুরশীদ রুমী

কয়েকজন ছেলেমেয়ে এক পার্টিতে গিয়েছিলো। রাস্তার ওপাশে একটা কবরস্থান আছে। ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলো কবরস্থানটা কতটা ভীতিকর। “কখনই এত রাতে কবরের পাশেদাঁড়াতে হয় না”, একটা ছেলেবললো। “কবরের ভেতরের মানুষ হাত বাড়িয়ে ধরে মাটির তলায় টেনে নেয়।” “একেবারে বাজে কথা।”, একটা মেয়ে বললো কথাটা। “এটা একটা কুসংস্কার।” “তোমাকে আমি এক ডলার দেব যদি তুমি একা কবরস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পার।”, বলল ছেলেটা। “কবর আমার ভয় করে না।”, মেয়েটা বলল। “আমি এক্ষুণিযেতে চাই।” ছেলেটা একটা ছুরি বাড়িয়ে দিল মেয়েটার দিকে। “যে কোন একটা কবরে এই ছুরিটা গেঁথে রেখে আসবে।”, বলল সে। “পরে আমরা গিয়ে দেখবো।” পুরো কবরস্থানটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আর মৃতের মতো নিস্তব্ধ। “ভয় পাবার মতো কিছু নেই।”, মেয়েটি বিড়বিড় করে নিজেকেবলল। কিন্তু তারপরেও ভয় তাকে ছেঁকে ধরল। মেয়েটি একটি কবর পেয়ে তারপাশে দাঁড়াল। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে ছুরিটা মাটিতে গেঁথে দিল। দ্রুত ফিরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। কিন্তু এক পাও নড়তে পারল না। কিছু একটা তাকে টেনে ধরল। দ্বিতীয়বারের মতো চেষ্টা করল। কিন্তু তারপরও নড়তে পারল না। আতঙ্ক ওকে ছেঁকেধরল। “কেউ আমাকে ধরেছে!”, চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল সে। যখন মেয়েটি ফিরে এল না, তখন অন্যরা তার খোঁজে বেরহল। দেখল, মেয়েটি একটা কবরের পাশে পড়ে আছে। বুঝতে না পেরে মেয়েটি স্কার্টের কাপড়সহ মাটিতে ছুরি গেঁথেফেলেছিল। আর ওই ছুরিটাই তাকে আটকে দিয়েছিল। ভয়ে মারা গেছে সে। মূল গল্প : দি গার্ল হু স্টুড অন এ গ্রেভ
||সমাপ্ত||

Snack's 1967