Duck hunt
প্রেমের প্রান্তে পরাশর
প্রেমের প্রান্তে পরাসর [খন্ডঃ ০১]
লেখক পরিচিতি
প্রেমেন্দ্র মিত্রঃ জন্ম ১৯০৪; মৃত্যু ১৯৮৮। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্রকার । ১৪-টি চলচ্চিত্রের পরিচালক, চিত্রনাট্য লিখেছেন অজস্র। ‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যগ্রন্থ লিখে পান আকাদেমি পুরস্কার ও রবীন্দ্রপুরস্কার। বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশনকে সাহিত্যের মর্যাদা তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন ঘনাদাকে সৃষ্টি করে। গোয়েন্দা সাহিত্যর ওঁর অবদান পরাশর বর্মা। পরাশর বর্মার বই মূলতঃ বড়দের জন্যে লেখা, তাই কিশোরদের গোয়েন্দাকাহিনী সংগ্রহে পরাশর বর্মাকে চোখে পড়ে না। ‘প্রেমের প্রান্তে পরাশর’ উপন্যাসটি এ. মুখার্জী এণ্ড কোং প্রকাশিত ‘পরাশর সমগ্র’ থেকে নেওয়া। এটি এখানে ছাপানোর অনুমতি দিয়ে তার কর্ণধার রঞ্জন সেনগুপ্ত আমাদের বাধিত করেছেন।
এক
"চন্দ্রগোমীর ব্যাকরণের কোনো খণ্ডিত পুঁথি কি এখনপাওয়া যায়?
বৈয়াকরণ শাকটায়ন যে চান্দ্র ব্যাকরণের কাছে ঋণী, সে-ব্যাকরণ কি চন্দ্রগোমীরই রচিত 'সংজ্ঞক ব্যাকরণ'
চদ্রগোমী কি সত্যিই নাগার্জুন শূন্যবাদের অনুগামী চন্দ্রকীর্তির শিষ্য?"
ওপরে যা লেখা হয়েছে তা পড়তে পড়তে মাথা যদি কারুরএকটু গুলিয়ে যায় তাহলে তাকে দোষ দেবার কিছু নেই।গোয়েন্দা গল্প পড়তে বসে ভুল করে পুরাতত্ত্ব গবেষণার কোনো সন্দর্ভের পাতা খুলে ফেলা হয়েছে বলেযদি সন্দেহ হয়, সেটাও সহজেই মার্জনীয়। ওরকম সন্দেহ হওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক। আমারও হয়েছিল। আর কাগজে ছাপার অক্ষরে ঐ কথাগুলি পাঠ করেনয়, ভারতবর্ষের সর্বজনবিদিত বিখ্যাত এক আচার্য পণ্ডিতের পাঠাগারে মেঝের ওপর পাতা বিচিত্র নকসার চৈনিক মাদুরে বসে নিজের কানে পরাশর বর্মা আর আমি ছাড়া ও-কক্ষের তৃতীয় ব্যক্তির মধ্যে প্রশ্নোত্তরে ঐ জাতীয় আলোচনা শুনে।
আচার্যদেব তখনও এ ঘরে আসেননি। তাঁরই অপেক্ষায় আমরা তিনজন তাঁর পাঠাগারেবসে আছি। কিন্তু আমি ঠিক আচার্যদেবের অপেক্ষায় বসে আছি বললে সত্যের একান্ত অপলাপ হবে। আমি তাঁর জন্যে এখানে অপেক্ষাকরে নেই, তাঁর দেখা পাওয়ারবিন্দুমাত্র আগ্রহ নিয়ে এখানে আসিও নি।। তবু কেন যে এই সমাবেশে আমি উপস্থিত তা আশা করি ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না। হ্যাঁ, পরাশরের জন্যেই আমার এই বিড়ম্বনা।সে নাছোড়বান্দা হয়ে একরকমজোরজুলুম করে আমায় ধরে নিয়ে এসেছে। আসবার আগে অবশ্য প্রলোভন দেখিয়েছে অনেক। তার সঙ্গে গেলে নাকি এমন কিছু জানতে শুনতে পারব যা আমার সমস্তঅভিজ্ঞতার বাইরে। যেন সে আশ্বাসের গ্যারান্টি হিসেবেই আমার পকেটে একটা ছোট খাম গুঁজে দিয়ে বলেছে,- এখন থাক। সময় পেলে আজ রাত্রে পড়ে দেখো। তবে এসবভুজুং ভাজুং-এ অনায়াসে আমি বশ হতে পারতাম, কিন্তুহাতের একটা জিনিষ দেখে আমার টনক গোড়াতেই নড়ে গেছে। সন্ত্রস্ত হয়ে তার সব সাধাসাধি আর লোভ দেখানো তাই ঠেকাতে চেষ্টাকরেছি যথাসাধ্য।
পরাশরের হাতে যে জিনিষটি দেখেছিলাম সেটি একটি বই। ছোটখাটো চটি পকেট বই নয়। রঙিন মন-মাতানো ছবির দেশিকি বিদেশী উপন্যাস টুপন্যাসও নয়। দাঁতভাঙানামের ভাষাতত্ত্বের একটা থান ইঁটের আকারের বই। পরাশরেরহাতে কবিতার বইটা তবু কিছুটা গা সোয়া হয়ে গেছে, কিন্তু ভাষাতত্ত্বের কেতাবটা গোড়াতেই রীতিমত সন্দিগ্ধ করে তুলেছে। পরাশর যেখানকার একেবারে সৃষ্টিছাড়া যে অভিজ্ঞতার লোভ দেখাচ্ছে ঐ ভাষাতত্ত্বের সঙ্গে তার কোন সংস্রব থাকলে আমার আরএগিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়। কিন্তু কে কার কথা শোনে। পরাশরের অনুরোধ কাটাবার সমস্ত চেষ্টা যে বিফল হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে যাঁর বাড়িতে এসে একাধারে তাঁর পাঠাগার ও বসবার ঘরেমেঝের মূল্যবান মাদুরের আসনে বসে আছি, পুরাতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বের অদ্বিতীয় পণ্ডিত হিসাবে তাঁর খ্যাতি ভারতের বাইরে সারাবিশ্বে ছড়ানো। নাম না করলেও অনেকেই হয়ত বুঝতে পারবেন বলে নামটা আর করলাম না। আচার্যদেবের পাঠাগারে বসে আছি খুব কমক্ষণ নয়। পরাশরের তার পণ্ডিতি আলোচনায় মগ্ন হয়েসময়ের খেয়াল হয়ত নেই, আমি কিন্তু ঘরে ঢোকবার পর থেকে দরজার মাথায় দেয়াল ঘড়িটার ওপর আগাগোড়াই নজর রেখেছি। তাতে এক মিনিট দুমিনিট করে পুরো সাতাশ মিনিট এ পর্যন্ত কেটেছে। শুধু ঘড়ির কাঁটার দিকে অবশ্য নয়, পরাশরের সঙ্গে যিনি এইসব দাঁতভাঙা আলোচনা চালাচ্ছেন ঘরের সেই তৃতীয় ব্যক্তিটির দিকেও মনোযোগ না দিয়ে পারি নি। মনোযোগ দেবার মতই ব্যক্তি অবশ্য। শুধু মনোযোগ দেবারই নয়, বেশ একটু বিস্মিত কৌতূহল অনুভব করবারও। ব্যক্তিটি পুরুষ নয় নারী, এবং বাঙালীবা ভারতীয় নয়, বিদেশী যুবতী।
বিদেশ বলতে কোন দেশের তা অবশ্য তাঁকে দেখে বলা সম্ভব নয়। তাঁর পোষাকটা আর একটু বেখাপ্পা হলে তাঁকে বিশ্ব নাগরিক হিপি ভাবা যেত। কিন্তু দেশী-বিদেশীর অদ্ভুত সংমিশ্রণ হলেও সে পোষাকে সযত্ন অযত্নের ছাপ নেই। একটু যেন জীর্ণ পুরোনো মনে হলেও নিম্নাঙ্গের ঢলঢলে সায়ার মত আবরণ আর উর্দ্ধাঙ্গের বেদিয়ানী কোর্তার ধরণের পোষাক দুটিনোংরা ময়না নয় বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মাঠায় চুড়ো বাঁধা সাদাটে যাকে বলে প্ল্যাটিনাম চুলে পারিপাট্য না থাকলেওএকটু ছিরি ছাঁদ আছে আর প্রসাধন বিহীন মুখখানাও শ্রীহীন নয়। কোন দিক দিয়েই নিখুঁত না হলেও গড়নপেটন সবশুদ্ধ জড়িয়ে যত ক্ষীণই হোক কেমন একটু মোহিনীভাবই মেয়েটির আছে বলে মনে হয়।
এ সব দিযে আর যাই হোক তাঁরজাতি কুলশীল ত' জানা যায় না। পোষাক চেহারা দিয়ে যাসম্ভব নয় তার ভাষা দিয়ে তা বুঝব তারও উপায় নেই। বিদেশী মেয়েটি ইউরোপীয় কোনো ভাষায় নয়, কথা বলছে আমাদেরই বাংলা ভাষায়। এবংবলছে একেবারেই স্বচ্ছন্দে। উচ্চারণে সামান্য একটু আধটু আড়ষ্টতা আর টান অবশ্য আছে। কিন্তু তা থেকে তার মাতৃভাষা অনুমান করবার মতক্ষমতা আমার অন্তত নেই। দেয়াল ঘড়িতে সাতাশ মিনিট আধ ঘণ্টায় গিয়ে পৌঁছেছে ইতিমধ্যে। আচার্যদেব আজ আর কখন আসবেন। তার এত দেরী করার কারণ কি।
ঘরের বাইরের করিডর দিয়ে যে দু' একজন পরিচারককে মাঝে মাঝে যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে তাদের কাউকে জিজ্ঞেস করাটা এখন অন্যায়হবে না। কিন্তু জিজ্ঞেস করবে কে? আমার পক্ষে সেটাকি শোভন হবে না। আর পরাশর যেরকম তন্ময় হয়ে আলোচনা চালাচ্ছে তাতে আচার্যদেবের আসতে দেরী হওয়ার জন্যে কোনো অস্থিরতা তার আছে বলে মনেহয় না। হঠাৎ কথাটা মাথার মধ্যে একটা ঝিলিক খেলে গেল। পরাশরের হঠাৎ পুরাতত্ত্ব নিয়ে এত মত্ত হবার সহজ ব্যাখ্যাই কি আমার সামনে মূর্তিমতী হয়েবসে আছে? কিন্তু কে ইনি? এঁর সঙ্গে পরাশরের আলাপ পরিচয় হল কোথায়? আর এতদিনবাদে হৃদয় ঘটিত ব্যাপার যদি পরাশরের একটা ঘটেই থাকে তার জন্যে সৃষ্টিছাড়া অভিজ্ঞতার লোভ দেখিয়ে আমায় সঙ্গে আনবার দরকারটা কি? আমায় কি সাক্ষী হিসেবে রাখা? কিসের সাক্ষী?
এক একজন মানুষ অবশ্য একটুবেশী মাত্রায় যাকে বলে লোক দেখানো স্বভাবের থাকে। প্রেমের জাগরণের মতনিভৃত গভীর ব্যাপারও তারাকাউকে না জনিয়ে না শুনিয়েসুখ পায় না। কিন্তু পরাশরঅমন সস্তা একজিবিশনিষ্ট ত' কোনো কালেই নয়। বিশেষত প্রণয় ঘটিত ব্যাপার এতকালবাদে তার জীবনে যদি ঘটেই থাকে সেটাকে সে পারতপক্ষেগোপন রাখতেই চাইবে।

তাহলেকিছু না জানিয়ে শুনিয়ে আমার দেখবার সুযোগ দিয়ে আমার অনুমোদনটা নেওয়াই কিতার উদ্দেশ্য? সেটা হওয়া অসম্ভব নয়। পরাশর নেহাৎ ছেলে ছোকরা ত আর নয়। প্রথম যৌবন পার হতেই চলেছে বলা যায়। এ বয়সে এরকম একটা কিছু ঘটলে একটুসাবধানে পা বাড়ানোই ভালো।এর ওপর মেয়েটি যখন বিদেশীতখন নিজের পছন্দ অপছন্দ ছাড়া পাকা বুদ্ধির দারুর সমর্থন চাওয়াটা পরাশরের পক্ষে উচিতই হয়েছে।
নিজের দায়িত্বটা বুঝে মেয়েটিকে বেশ একটু খুঁটিয়েই এবার লক্ষ করলাম। ফিল্মে নামবার মত সুন্দরী না হলেও একটা চটকযে চেহারায় আছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। চটকটা একটু নয়, আছে বেশ বেশী মাত্রাতেই। আর সেটা শুধু মুখ চোখের নয় সমস্ত শরীরের। পোষাকের বর্ণনা আগেই করেছি। সেই কিছুটা ইরাণী বেদিয়ানীদের ধরণের গায়ের ঝোলাকুর্তা আর তার তলায় সায়া আর লুঙ্গির মিশ্রণের জেল্লাহীন বিনা বাহারের বেশবাসের ভেতর দিয়েই দেহ সৌষ্ঠবের মাদকতা কেমন করে ফুটে বেরুচ্ছে তা বলা শক্ত। হয়ত মেঝের ওপর বসার অনভ্যস্ত ভঙ্গির দরুণ দেহে প্রচ্ছন্ন রেখার এখানে ওখানে একটু ইঙ্গিতইতার জন্যে যথেষ্ট।
এ রকম মেয়ের প্রতি আকৃষ্টহওয়া পরাশরের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর শুধু চেহারায় চটকই নয়। মেয়েটির মুখ চোখে বুদ্ধিরদীপ্তিটাও বেশ স্পষ্ট। তার কাছে যা সম্পূর্ণ বেদেশী সেই ভাষায় বেশ একটু কষ্ট করে কথা বলতে হলেও অবাধে এতক্ষণ ধরে সেআলাপ চালিয়ে যাচ্ছে সেইটেই ত আশ্চর্য। কথা যাবলছে ভাষাটা বাংলা বলেও তা আমার কাছে অব্শ্য পুরোপুরি গ্রীক। সব কথায় কানই দিচ্ছি না। মাঝে মাঝে দু-একটা যা কানে আটকে যাচ্ছে সেই কটিই মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। যেমন পরাশরের কি একটা প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটিকে বলতে শুনেছি,"না আমি আচার্যদেবের কাছে'কাশিকা বৃত্তি' সম্বন্ধে কয়েকটা কথা জানতে এসেছি।"এ কথার উত্তরে পরাশর যা বলেছে তাতেও অবশ্য আমার চক্ষু স্থির।
পরাশর বলেছে,"কাশিকাবৃত্তি ত বামন আর জয়াদিত্য দুজনের এক সঙ্গেলেখা।"
মেয়েটি মাথা নেড়ে সায় দিয়েছে।
পরাশর তাতে আবার বলেছে,"কিন্তু কাশিকা বৃত্তিতে না বলে অন্কে কিছু চুরি করে দুই পণ্ডিত চ্দ্রগোমীকি চান্ত্র ব্যাকরণের নামপর্যন্ত করেন নি।..."
এতখানি শোনবার পর আমার কনের ফুটো আপনা থেকেই যেনবুজে গেছে।
মাথাটা গুলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে একবার এমন সন্দেহও জেগেছে যে ব্যাপারটা আগাগোড়া আমায় বোকা বানাবার ফিকির না ত? দুজনে মিলে আগে থাকতে ষড় করে রেখে এই সব হিংটিং ছট আউড়ে আমায় হকচকিয়ে দেওয়াইএদের মজা।এ সন্দেহটা অবশ্য মনের মধ্য উঠতে না উঠতেই সকৌতুকে উড়িয়ে দিয়েছি। পরাশর ও মেয়েটি বৌদ্ধ যুগের গুরু-গম্ভীর বিষয় নিয়েই আলোচনা করছে সন্দেহ নেই। কিন্তু পরাশরহঠাৎ এ বিষয়ে কবে থেকে উৎসাহী হয়ে উঠল? এ মেয়েটির সঙ্গে তার কি আগেথাকতেই আলাপ হয়েছিল? সে রকম কোনো লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। দুজন দাঁত ভাঙ্গা তত্ত্ব নিয়ে আলাপ চালাচ্ছে কিন্তু কেউকাউকে একবার নাম বা পদবী ধরেও সম্বোধন করে নি। তাতে দুজনেই দুজনের অজানাবলেই ধরে নিতে হয়। কিন্তুসে রকম হলে শিষ্টাচার মত আলাপের আগে পরাশরের পরিচয়টা দেওয়া নেওয়াই উচিত ছিল। তার বদলে খানিকটা বসে থাকবার পর কোন রকম ভূমিকা না করেই দুজন কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছে। কথা আগে বলেছে অবশ্য মেয়েটি। আমাদের আগেথাকতে সেই ঘরের মেঝেয় বসেছিল। মেয়েতি আগে কথা বলতে পরাশরের পক্ষে সুবিধে হয়েছে সন্দেহ নেই।কিন্তু মেয়েতি অচেনা অজানা একজনের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলল কি করে? এটা কি তার আধা হিপি হওয়ার লাইসেন্স! না আচার্যদেবের পাঠাগারের আবহাওয়ারই ওটা গুণ? এর ভেতর এসে বসলে ও সব ভুয়ো আদব-কায়দার কোনো মানে থাকে না। পরাশর আর মেয়েটির সোজাসুজি আলাপ শুরু করতে তাই বাধেনি।
মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও সে যে পরাশরের অচেনা নয় তা অবশ্য কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই বোঝ শক্ত হয় নি। পরাশর কোথাও না কোথাও মেয়েটিকে দেখেছে আর তারপর তার সঙ্গে আলাপ করবার সুযোগ খুঁজে আচার্যদেবের বাড়িতে আজ এসে হাজির হয়েছে। আগে থাকতে মেয়েটিকে না চিনলে আমাকেওআজ সঙ্গে করে ধরে আনার মান থাকত না। নিজের পছন্দটা পরাশর আমাকে দিয়েএকটু যাচাই করাতেই চায়।
তা করবার জন্যে তা তোড়জোড়টা দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নেহাৎ ভাসাভাসা সাময়িক কিছু নয়।পঞ্চশরের তীরটা আচমকা একটু গভীরভাবেই বিঁধেছে। একটু দেখা পাওয়া যায় আলাপকরবার সুযোগের জন্যে তাকেআমায় নিয়ে পণ্ডিত শিরোমণিএই আচার্যদেবের বাড়িতে ছুটে আসতে হয়েছে তাই। পরাশরের হঠাৎ পুরাতত্ত্ব নিয়ে মেতে ওঠার পেছনে কি আছে এখন আর বোঝা শক্ত নয়। এখানে এসে আর কিছু না হোক কাছাকাছি বসে একটু কথা বলার সৌভাগ্য পরাশরের হয়েছে। তারপরে অবশ্য অনেকধাপ বাকি। পরস্পরের নাম ধাম জানা থেকে, দেখা শোনারসুযোগ করে নেওয়া ইত্যাদি ধাপগুলো ত আগে না পেরুলে নয়। তাতে আমার কাছে কোনো সাহায্যের আশা কি পরাশর করে? করা তার পক্ষে স্বাভাবিক কিন্তু মেয়েটির নাম পর্যন্ত না জেনে কি-ই বা করতে পারি আমি?
মেয়েটি এতক্ষণের মধ্যে বেশ কয়েকবার আমায় লক্ষ অবশ্য করেছে। আমার আগাগোড়া চুপ কে থাকে দেখেখুব একটা সম্ভ্রম মেশানো ধারণা নিশ্চয় আমার সম্বন্ধে হয় নি। তা না হোক। এতক্ষণের ধারণাটা একটু শুধরে দেবার ব্যবস্থা এবার করলাম। সেইসঙ্গে মেয়েটির পরিচয় যাতেজানা যেতে পারে সে রকম একটা চেষ্টাও। ঘরের দেয়ালঘড়িটার দিকে এ পর্যন্ত বহুবারই তাকিয়েছি। এখন তকানোটা সরব করে তুলে বেশঅধৈর্যের সঙ্গে নিজেকেই যেন বললাম, "দশটা ত বাজতে চলল। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়?
পরাশর ও মেয়েটি তাদের আলোচনা থামিয়ে তখন আমার দিকে তাকিয়েছে। পরাশরের দিকে সোজা তাকাইনি। তার চোখে হয়ত একটু ভ্রুকুটি থাকতে পারে। কিন্তু মেয়েটির মুখে ইষৎ হাসির আভাস। সেইটেকেই সহানুভূতি বলে ধরে নিয়ে সোজাসুজি বললাম,, "আমরা ত প্রায় চল্লিশ মিনিট এসেছি। আপনি ত তারো আগে এসেছেন। অপেক্ষা করে আছেনকতক্ষণ!"
আগের অধৈর্য প্রকাশটা বাংলায় করে থাকলেও এবার ইচ্ছা ক্রেই ইংরেজি ব্যবহার করেছি। কথাগুলো সোজা। প্রশ্নটার মধ্যেও জটিল কিছু নেই। কিন্তু মেয়েটি তাতেই অমন হতভম্ব হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকবেভাবতে পারিনি। আমার কথাটাহয়ত একটু ভুল বুঝেছে ভেবেবেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে মাফ চাইবার ভঙ্গিতে বললাম, "আমি শুধু আপনি আমাদের চেয়েও আরো কতক্ষণ অপেক্ষা করছেন তাই জানতে চেয়েছি।"

মেয়েটির মুখ তাতেও কিন্তুযেমন বিমূঢ় বিব্রত ছিল তেমনিই রইল। সেই সঙ্গে একটু কেমন যেন অসহায় ও করুণ।
কি এমন অন্যায় অশোভন কথা বলে ফেলেছি কিছুই না বুঝতে পেরে, এবার নিজেই রীতিমত ঘাবড়ে গিয়ে সাহায্যের জন্যে পরাশরের দিকে ফিরে তার শরণ নিতে যচ্ছিলাম, হঠাৎ কথায় চমকে তার দিকে তাকালাম।
মেয়েটি বেশ একটু সঙ্কোচেরসঙ্গে পরিষ্কার বাংলায় তখন বলছে, "অনুগ্রহ করে আমায মাপ করবেন। আমি ঐ ইংরেজিটা জানি না।"
ইংরেজি জানেন না! প্রথম বিস্ময়ে কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবার পরই নিজের মূর্খতার লজ্জা পেলাম। বিদেশী ইউরোপীয় মেয়ে হলেইইংরেজি অবশ্যই জানবে বলে ধরে নেওয়াটা যে কতখানি নির্বুদ্ধিতা তা তখন ভালোভাবেই বুঝে মর্জনা চাইতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তার সুযোগ মিলল না।
মেয়েটি তখন নিজেই কুণ্ঠিতভাবে কৈফিয়ত দিয়ে চলেছে, "দেখুন অমি আর্জেণ্টিনার মেযে। স্প্যানিশের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, এমন কি ইতালিয়ানও একটু আধটু বলতেপারলেও ইংরেজিটা আর শেখা হয় নি। আপনাদের বাংলা ভাষাটা অবশ্য আমি আমার প্রাচ্য পুরাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্যে সংস্কৃত পালির সঙ্গে সামান্য একটুশিখেছি। আপনি ইংরেজিতে কিবললেন বুঝতে না পেরে ওরকমচুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। আপনি নিশ্চয়ই তাতে আমায় অসভ্য ভেবেছেন।আমার সে অনিচ্ছাকৃত অভদ্রতার জন্যে মাপ চাইছিআবার।"
অনিচ্ছাকৃত আর অভদ্রতা এইদুটি শব্দে সামান্য একটু হোঁচোট খেলেও মেয়েটি গড়গড়করে এতখানি বাংলা বলে যাওয়ায় তখন আমি অবাক আর অভিভূত।
যে পরাশর এতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নীরব শ্রোতা হয়েই ছিল সে এবার একটু গম্ভীর ভাবেই মন্তব্য করলে, "শুনুন,, মাপ চাইলে আমার বন্ধুরই চাওয়া উচিত।পৃথিবীটা যে ইংরেজদের খাসতালুক নয় এ খবরটা এখনও ও জানে না।"
মেয়েটির সঙ্গে আমিও এ কথায় হাসলাম।
কিন্তু সেই সঙ্গে পরাশরেরওপর একটু রাগও হল। এমন একটা সুযোগ পেয়েও নষ্ট করতে হয়। আমাকে খোঁচা দেবার ছুতোয় আমার নামটা বলে দিলে ক্ষতি কি ছিল? শেষ কথাটায় আমার বন্ধু জানেনা-র মধ্যে কৃত্তিবাস নামটা অনায়াসে ঢুকিয়ে দেওয়া যেত, আর তাহলে কথার পিঠে কথা এসে মেয়েটির নাম ধাম জানার একটা সুবিধে কি হত না?
এত কাণ্ডের পর নামটাই যে অজানা হয়ে রইল।
দুই
শেষ পর্যন্ত তা কিন্তু রইল না।
সেই দিনই সকালে এক সঙ্গে অতগুলো সুযোগ হয়ে যাবে তাভাবতে পারিনি। আচার্যদেবের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য অবশ্য হয় নি। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পর আরো মিনিট পনেরো অপেক্ষা করবার পর জানা গেল, আচার্যদেব একটা জরুরী মিটিং-এ কোথায় আটকে পড়েছিলেন। বাড়ি ফিরতে তাঁর দেরী হবে। বাড়িতে ফোন করে তাই দর্শনপ্রার্থী কাউকে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করতে বারণ করার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির একজন ওপরের সে ফোনের সংবাদ আমাদের জানিয়ে গেলেন।
খবরটা শুনে পরাশর আর মেয়েটি রীতিমত হতাশ। এক সঙ্গেই বাইরে যেতে যেতে মেয়েটি তার সমস্যার কথা জানালে। আচার্যদেবের কাছে কয়েকটা জরুরী বিষয় জেনে না নিলে যে জন্যে সে ভারতবর্ষে এসেছে সে কাজই সে শেষ করতে পারবে না। অথচ আজ নিয়ে দুদিন নাকি তার বসবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আচার্যদেব শেষ পর্যন্ত এমনি ভাবেই অন্য কিছুতে আটকে পড়ে কথা রাখতে পারেন নি।
কথা বলতে বলতে আচার্যদেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা তখন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। এরপর বিদায় নমস্কার জানিয়ে যে যার পথে যাবার পালা। পরাশরের এখনো পর্যন্ত এই মুহূর্তটাকে কাজে লাগাবার কোনো লক্ষণ নেই দেখে নিজেকেই গায়ে পড়া হয়ে কথাটা তুলতে হল।
"আপনি যাবেন কোন দিকে?" মেয়েটিকে বাংলাতেই জিজ্ঞাসা করলাম।
"আমি!" মেয়েটি যেন এ প্রশ্নে একটু বিচলিত,"আমি - আমি উত্তর দিকেই যাব।"
সেই সঙ্গে আর একটা যা প্রশ্ন করলে তা আমি তার মুখ থেকে আসতে পারে বলে ভাবিনি।
মেয়েটির জিজ্ঞাসা হল,"আচ্ছা এখান থেকে আপনাদেরঐ কি বলে মিনি বাস পাওয়া যায় না?"
"পাওয়া যাবে না কেন!" মেয়েটির মিনিবাসে যেতে চাওয়ায় অবাক হলেও বিস্ময়টা গোপন করে বললাম,"কিন্তু এখন অফিসের সময়। উত্তরমুখো কোনো বাস ট্রামই ত খালি পাওয়া যাবেনা। তা আপনি যাবেন কতদূর?"
"তা যাব একটু দূর।" মেয়েটি কুণ্ঠিত ভাবে জানালে, "সেই দমদমের কাছে।"
দমদমের কাছে শুনে সত্যিই একটু দমে গিয়ে যখন এই ভিড়ের সময়ে সেখানে পৌঁছোবার একটু সুলভ ও সুবিধাজনক বাস রুটের কথা ভাবছি, পরাশর ততক্ষণে বেপরোয়া হয়ে একটা চলতি ট্যাকসি ডেকে থামিয়ে ফেলেছে।
কাজটা বীরোচিতই হয়েছে সন্দেহ নেই, সিভ্যালরির পরিচয় দিতে এটুকু না করে উপায় ছিল না। কিন্তু আমি থখন নিজের পকেটের অবস্থা জেনে দমদম পর্যন্ত ট্যাকসির মিটারের নির্দেশ অনুমান করে শঙ্কিত না হয়ে পারি নি।
যে মেয়ে দমদমে যাবার জন্যে মিনি বাসের খোঁজ করে তাকে ট্যাকসি ডেকে দেওয়াটা সত্যিই উপকার করাকি না তাও ভাববার বিষয়।
ট্যাকসি দাঁড়াতে দেখে সেইজন্যেই মেয়েটিকে কেমন একটু ইতস্ততঃ করতে বোধ হয়দেখলাম।
পরাশর অবশ্য ততক্ষণে ট্যাকসির দরজা খুলে ধরে ডাকছে, "আসুন।"
মেয়েটি একটু দ্বিধাভরে যতক্ষণে ট্যাকসিতে গিয়ে উঠল ততক্ষণ আমি পরাশর এরপর কি করবে ভেবে রীতিমতউদ্বিগ্ন হয়ে রইলাম। পরাশর কি মেয়েটিকে ট্যাকসিতে উঠিয়ে ছেড়ে দেবে?
না, তা পরাশর দিলে না। মেয়েটি ভেতরে গিয়ে ওঠবার পর আমার গড়িমসিতে যে অধৈর্য দেখিয়ে বললে, "কই, এসো কৃত্তিবাস?"
"আমি!" অকপট বিস্ময়ের সঙ্গে একটু ভীত ভাবেই পরাশরের দিকে চাইলাম,"আমায় ডাকছ কেন? আমার এখনঅতদূর দমদমে যাওয়ার একটু অসুবিধে আছে।"
"অসুবিধে আবার কি?" পরাশরএবার হাত ধরেই আমায় ভেতরেঢুকিয়ে দিয়ে নিজে পাশে এসে বসে ড্রাইভারকে দমদম যাবার নির্দেশ দিলে।
পরাশর এমনভাবে আমাকে নিয়েট্যাকসিতে ওঠায়, ভাড়ার ভাবনাটা থেকে তখন মুক্তি পেয়েছি। মেয়েটির ফেরবার সমস্যা মেটাবার সঙ্গে তারঠিকানাটাও জেনে আসার এ সুযোগ ছেড়ে দেওয়াই তার পক্ষে আহাম্মকি হত।
কিন্তু যার জন্যে এত করা সে মেয়েটির প্রতিক্রিয়াটা কি সেইটেই ত বোঝা যাচ্ছে না।

তিন
গড়িয়াহাট রোড ধরে গাড়িটা তখন উত্তরের দিকে চলেছে। সেই দক্ষিণ কলকাতায় ট্যাকসিতে ওঠবার পর থেকে মেয়েটি কেমন একটু অন্যমন্স্ক হয়ে সমানে বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে। বপুটি আমার নেহাত শীর্ণ নয়। পেছনের সীটে তিনজন পাশাপাশি বসার জন্যে একটু ঘেঁষাঘেঁষিই হয়েছে। মেয়েটির সুগঠিত দেহের কিছু কিছু অংশের স্পর্শ এড়াবার তাতে উপায় নেই। দেহের সে স্পর্শ দিয়ে মনের কথা ত আর বোঝা যায় না। গেলে হয়ত তাতে খুশি হবার মত কিছু পেতাম না। পরাশর তার পরিবহন সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু এ সমাধান তার ঠিক মনঃপুত না হওয়ারই কথা। মেয়েটি থাকে সেই দমদমে সেখানে যাবার জন্যে নিজে থেকে সে মিনিবাসের খোঁজ করেছে। তার মানে তার আর্থিক সঙ্গতি তেমন যথেষ্ট নয় বলেই ত মনে হয়। পরাশর নিজেথেকে ট্যাকসি ডেকে তাকে পৌঁছে দেবার জন্যে সঙ্গী হওয়ায় মেয়েটির সে দিক দিয়ে এখন অবশ্য বিব্রত হতে হবে না, কিন্তু কোথায় সে থাকে তা জানাবার উৎসাহ তার নেই এমনও হতে পারে।
দমদমে কোথায় থাকবার আস্তানা সে পেয়েছে ত অবশ্য জানি না, তবে তার পোষাক-আশাক দেখে জায়গাটা ডেকে দেখাবার মত নয় বলেই তমেন হয়।
ঠিক হিপিদের পর্যায়ে মেয়েটি পড়ে না বটে, কিন্তুহিপিরা যেখানে সেখানে যদিথাকতে পারে, মেয়েটির পক্ষে নিতান্ত সাধারণ কোনো আশ্রয়ে থাকা ত থাহলে অসম্ভব নয়। আপত্তি না করলেও তার সেই ঠিকানাটুকুবাধ্য হয়ে জানাতে হচ্ছে বলেই হয়ত মেয়েটির হঠাৎ এই মনমরা আনমনা ভাব। তাতে লোকসান অবশ্য আমাদেরই। আমাদেরই মানে আসলে পরাশরেরই। এতক্ষণ একসঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়েপরিচয়টা গভীর করা পরাশরেরআর হয়ে উঠল না। মেয়েটির থাকবার জায়গাটা সে দেখে আসবে বটে, কিন্তু গোড়াতেই এমনভাবে সুর কেটে যাবার পর আবার নতুন করে জমানো আরকিছু না হোক সহজ নিশ্চয় হবে ন। এ ব্যাপারে বন্ধু হিসেবে আমিই বা কি করতে পারি ভেবে পেলাম না। গায়ে পড়ে আলাপ যে না করা যায় তানয়। তাতে আমাকে বেশ খেলো হতে হলেও বন্ধুর খাতিরে তা আমি হতে প্রস্তুত। কিন্তু আলাপটা শুরু করব কি নিয়ে? পরাশরের মত পুরাতত্ত্ব কি ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে ছিটেফোঁটা জানাশোনা থাকলেও তাই নিয়ে আলাপটা শুরু করতে পারতাম। কিন্তুএসব বিষয়ে আমার যা বিদ্যে তাতে দন্তস্ফুট করলে শুধুহাসির খোরাকই যোগাবে। আলাপ শুরু করার ও পথ সুতরাং বন্ধ। মেয়েটি বলেছে সে আর্জেণ্টিনার মেয়ে। ঐ আর্জেণ্টিনা দিয়েই কথাটা শুরু করব নাকি? আর্জেণ্টিনা সম্বন্ধেও বেশী কিছু যে জানি তা নয়, তবে তার রাজধানীর নামটা আর দু-একটা খবর জানা আছে। তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ব বলে একটু নড়েচড়ে বসতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলাম। প্রথমে নিজের কানটাকে বিশ্বাস করতেই একটু বাধল।তারপর বিস্ময়ের আর শেষ রইল না। যা শুনছি তা মিথ্যে নয়। মেয়েটিই নিজে থেকে কথা বলছে আর ক্ষোভ কিবিরক্তি নয় বেশ একটু কৌতুক মেশানো গলায়।
"কৃত্তিবাসবাবুর বড় বেশী শাস্তি হচ্ছে বুঝতে পারছি।"
মেয়েটি শুধু নিজে থেকে কথাই বলে নি, আমার নামটাও ঠিক মত উচ্চারন করে টিপ্পনী করেছে।
নামটা সেই একবার পরাশর বলেছিল ট্যাকসিতে ওঠবার সময়। তাতেই এতক্ষণ মনে রাখাই ত যথেষ্ট। তার ওপর ঐকৌতুকের সুরটুকু।
এরপর আর আমায় পায় কে? অকুতোভয়ে এগিয়ে গিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে নামটাম সবই বার করে ফেললাম। মেয়েটির নাম এলসা। আর্জের্ণ্টিনায় বাড়ি। সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ নিয়ে ভারতবর্ষের গুপ্তযুগের কয়েকজন বৌদ্ধ আচার্য পণ্ডিতদের সব্মন্ধে গবেষণা করে থিসিস লিখতে এখানে এসেছে। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের কয়েকটি জায়গায় ঘুরে সেখানকার কাজশেষ করেছে। এখন বাংলাদেশের কাজই তার বাকি। এখানকার কাজ শেষ করতে নানা কারণে দেরী হচ্ছে। তবু আশা করছে, সপ্তাহ দু-একের মধ্যেই কাজ শেষ কের ফিরে যেতে পারবে। এলসার পরিচয় যেতুকু পেলাম তা এমন কিছু নতুন কি আশ্চর্য নয়। আজকালকার দিন বিদেশ থেকে যে সব ছেলে মেয়ে ভারতবর্ষে পড়তে শুনতে কি বেড়িয়ে যেতে আসে তাদের অনেকের কাহিনীই এই ধরণের।
কিন্তু এরপর যা জানলাম তা সত্যই চমকে একেবারে বিমূঢ়করবার মত। ট্যাকসি এরোড্রোমের রাস্তায় অনেক দূর তখন চলে এসেছে। ড্রাইভার টার্মিন্যালের দিকেই গাড়ি চালাতে যাচ্ছিল, হঠাৎ এলসা বারণ করে বললে, "না, ওদিকে নয়।" ওদিকে নয় তা আগেই জানতাম, কিন্তু সত্যিই যাবে কোথায়? এরোড্রোমের এলাকা ছাড়লে অবশ্য কিছু বাগানবাড়ি গোছের কলকাতার সম্পন্ন মানুষের বিশ্রামকুঞ্জ গোছের আছে। তারই একটিতে আশ্রয় যোগাড় করেছে নাকি এলসা? না, সে রকম কোথাও নয়। নিজেই নির্দেশ দিয়ে এলসা যেখানেট্যাকসি নিয়ে গিয়ে থামলে তার সামনের দোকানটা দেখে আমার অন্ততঃ চক্ষুস্থির।

চার
এতো যাকে বলে পাঁচতারা মার্কা। আমীর ওমরাহদের থাকবার হোটেল। এলসা এখানেথাকে? নেহাৎ সাধারণ কমদানী কাপড়ের আধা-হিপি যার বেশবাস খানিক আগে এখানে আসবার জন্যে যে মিনিবাসের খোঁজ করছিল সেইপুরাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে আসা মেয়ের আস্তানা হল এই হোটেল।
পরাশর ট্যাকসির মিটার দেখে ভাড়া চুকিয়ে দিলে। দেবার সময় ভেবেছিলাম মেয়েটি আপত্তি করবে। তা সে করলে না। কিন্তু আমাদের নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিতে দিলে না। তাদের কফিবারে কয়েক মিনিটের জন্যে একবার অন্তত পা দিয়ে একটু কফি যেতে নিমন্ত্রণ জানালে।
নিজের পোষাক-আশাকের কথা ভেবে এই বাদশাহী হোটেলে সে নিমন্ত্রণ রাখবার খুব ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু পরাশরের দেখলাম একেবারে ভাত খাবি না আঁচাব কোথা গোছের অবস্থা।
বলতে না বলতে রাজী হযে সে প্রায় আমাদের সকলের আগে যেভাবে হোটেলে গিযে ঢুকল সেটা তখন আমাদের একটু খারাপই লেগেছিল।
কিন্তু পরে মনে হয়েছে যে তখন অমন করে না গেলে সেনর বারোহার সঙ্গে আলাপই হত না। আর সেটা এক দিক দিয়ে লোকসানই হত। কারণ সেনর বারোহা এমন একজন মানুষ আজকের দুনিয়ায় যাদের একতানতুন যুগের প্রতিনিধি বলাযায়। এ কাহিনী লিখতে লিখতে তাঁর পরিচয়টা ধীরে ধীরে সবই প্রকাশ পাবে। আপাততঃ এইটুকু বলাই যথেষ্ট যে প্রথম দেখাতেই দেশ বা বিদেশের কোন মানুষ আমার মনে এমন কৌতুহল জাগায়নি।
সেনর বরোহার সঙ্গে হোটেলেঢোকবার দেউড়িতেই প্রায় দেখা। তিনি হোটেল থেকে বেড়িয়ে কোথায় যচ্ছিলেন। আমাদের ঠিক নয়, এলসা কে দেখেই এক মুখ হেসে বিদেশী যে ভাষায় তাকে সম্ভাষণ করলেন সেটা স্প্যানিশ বলেই মনে হল। এলসা হেসে দাঁড়িযে তখনই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলে। পরিচয় কি যে দিলে তা অবশ্য বুঝলাম না। হয়ত, পরাশরের পরিচয় দিলে বাঙ্গালী একজনবড় পণ্ডিত গবেষক বলে আর আমাকে পরাশরের বন্ধু ও কলকাতায় একজন গণ্যমান্য কেউ হবার গৌরব দিলে। পরিচয় যাই দিক,, বারোহার দিক দিয়ে হৃদ্যতার তাতে অভাব হল না। বাইরে যাওয়া তার মাথায় উঠল, আমাদের সঙ্গে করমর্দন করে কফিবারেই সঙ্গী হল আমাদের। বারোহা অবশ্য ইংরেজী ভালো রকমই জানে। সত্যি কথা বলতে গেলে, নামটা না বলে প্রথেমেই আলাপ কারলে তার ইংরেজি শুনে সে যে ইংরেজ বা মার্কিনী নয়, তা বুঝতেই পারতাম না।
মানুষটা অবশ্য অনেক দিক দিযেই লক্ষ্য করবার মত। এলসা হোটেলের দরজায় তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই আমাদের ঢোকবার মুখে আর সকলের মধ্যে তার চেহারাটা চোখে পড়েছিল। নাপড়াটাই আশ্চর্য। ইস্পাত তীক্ষ্ণ। চাবুকের মত চেহারা যাকে বলে বারোহার ঠিক তাই। নামটা জানবার পর সে চেহারায় একট হদিসও পেয়েছি। বরোহা স্পেনের মানুষ। সে দেশের বুনো ক্ষেপিয়ে দেওয়া ষাঁড়ের সঙ্গে প্রাণ তুচ্ছ করে শুধু একটা লাল কাপড় আর নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে পা চালানোর কৌশল আর ক্ষিপ্রতায় যারা লড়ে বারোহা-র শিরায় সেই টোরিয়াডরদের রক্তই নিশ্চয় বইছে। তাই সাদাসিধে প্যাণ্ট সার্ট ওতার চলা ফেরায় যেন চিতার মত সুঠাম প্রাণীর সংহত বলিষ্ঠতা ফুটে বার হচ্ছে।পোষাক আশাক বা চেহারায় তেমন জৌলুস না থাক, ইংরাজিনা জেনেই এলসা এখানে বেশ জনপ্রিয় দেখলাম।
কফিবারে কফি খাবার সময় অনেকেই তাকে প্রীতি সম্ভাষণ জানিয়ে গেল। মঁসিযে রেনোয়া নামে একজন ফরাসী প্রৌঢ় তার ভাগনীকে নিয়ে খানিকক্ষণ ত আমাদের টেবিলে বসে এক পাত্র করে কফিই খেয়ে গেলেন। এঁদের সকলের সঙ্গেই এলসা তাঁদেরভাষাতেই আলাপ চালালে। বারোহার সঙ্গে যেমন স্প্যানিশ, রেনোয়া আর তার ভাগনীর সঙ্গে তেমন ফরাসীতে। শুধু ইংরাজিটা সে কেন যে শেখেনি সেইটা আশ্চর্য। কফি খাওয়া পর্ব শেষ করে হোটেল থেকে কলকাতা ফেরবার সময় বারোহাও সেই কথা বলে দুঃখ করলে।
হোটেল থেকে আমরা তার গাড়িতেই কলকাতায় ফিরছিলাম। কফি খাওয়ার পর এলসার কাছে বিদায় নেবার সময় সে নিজে থেকেই আমাদের কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে দেবার কথা বলেছে। এটা তার অতিরিক্ত কিছু সৌজন্য নয়।এলসা আর আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার আগে সে কলকাতায় যাবার জন্যেই বেরিয়ে আসছিল। এলসাকে দেখে ও আমাদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় যাওয়াটা কিছুক্ষণ স্থগিত থেকেছে মাত্র। বারোহার গাড়িটা রীতিমত খানদানি ও বিরাট। কোন আপত্তি না শুনে সে তারসংগে সামনের সীটেই আমাদেরবসিযে নিয়েছে। গাড়িটা যা ঢাউস তাতে জায়গায় অকুলান কিছু হয় নি।
হোটেল থেকে কলকাতার দিকে আসতে আসতে বারোহার মোটামুটি পরিচয় পেয়েছি। বারোহা নিজেই তা দিয়েছে। সে মূল স্পেনের লোক তবে স্পেনে নয় দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে থেকেই তার ব্যবসা চালায়। ব্যবসাতার জৈব সার গুয়ানো নিয়ে। পেরু ও চিলির পশ্চিম প্রান্তের কয়েকটা দ্বীপে হাজার হাজার বছর ধরে সামুদ্রিক পাখীদের দৌলতে সে জৈব সার রশি রশি জমা হয়ে আছে। এক কালে সে সারেরচাহিদা আর কদর যা ছিল, ফার্টিলাইজারে কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার তৈরীর পদ্ধতি উদ্ভাবনের পর থেকেতা অনেকটা কমলেও গুয়ানোর ব্যবসায় এখনও লোকসান নেই।বারোহার কাছে অবশ্য তার ববসাই ধ্যান জ্ঞান নয়। বছরে ন'মাস সে মনপ্রাণ দিয়ে ব্যবসা করে। তারপর তিনমাস ছুটি নিয়ে পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। এই ঘুরে বেড়ানোই তার নেশা।
বারোহা মানুষটা সত্যিই বুঝলাম নিতান্ত সরল। নইলেমাত্র খানিকক্ষণের আলাপে আমাদের কাছে এত কথা বলে ফেলবে কেন? তার কথায় খেই ধরেই একবার জিজ্ঞাসা করলাম, সে আগে কখনো ভারতবর্ষে এসেছে কি না।
"না, আসি নি," হেসে বললে বারোহা। "না এসে খুব ভুল করেছি।"
"তার মানে ভারতবর্ষ আপনারভালো লাগছে?"
"ভালো লাগছে মানে!" বারোহা যেন অবাক হল, "এদেশভালো না লেগে পারে! আমার তমনে হয় আমি আগের জন্মে এদেশেই কোথাও জন্মেছিলাম।"
"আগের জন্মে এদেশে জন্মেছিলেন, "আমি হেসে উঠলাম, তার মানে জন্মান্তরে আপনি বিশ্বাস করেন?"
"আগে করতাম না। এদেশে আসবার পর করি।" একটু থেমে বারোহা সামনের দুটো গাড়িকে নিপুণভাবে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে আবার বললে, "আপনার দেশ যত দেখছিতত যেন একটা অজানা আকর্ষণ আমায় টানছে মনে হচ্ছে।"
কিন্তু এবার আমি একটু উল্টো না গেয়ে পারলাম না,"এরকম হোটেল থেকে এরকম মোটরে চড়ে যা দেখেছেন তা ঠিক আসল ভারতবর্ষ নয়।"
"হ্যাঁ," বারোহা গম্ভীর হয়ে বললে। "এলসাও তাই বলে,আসল ভারতবর্ষকে জানতে হলেক্যাডিল্যাক চড়ে বড় বড় সদর রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে কিছু জানা যায় না। কিন্তু আমার উপায় কি বলুন। আমার ছুটির মাত্র এক মাস আর বাকি।

আমার ছুটির মাত্র এক মাস আর বাকি। এক মাসের মধ্যে এবারের মত ভারতবর্ষ ঘুরে ঘুরে যতটা পারি আমার দেখে যেতে হবে। এ গাড়িটা তাই আমি আসার আগে থাকতে জাহাজে এখানে আনিয়ে রাখারব্যবস্থা করেছিলাম। এলসা এ গাড়ি নিয়ে ঠাট্টা করে। কিন্তু তার ঠাট্টা শুনলে আমার আর ভারতবর্ষ বেড়ানোইহয় না। আমি ত তার মত এই দেশ নিয়ে পড়াশোনা আর গবেষণা করতে আসি নি। শিকড় গজিয়ে কোথাও বসে থেকে আমি করব কি?"
একটু হেসে বললাম, "কিন্তু মিস এলসাও ত এখানে থাকছেন না। কদিন বাদেই ওঁকে আর্জেণ্টিনায় ফিরে যেতে হবে বললেন।"
"তাই বলেছে নাকি আপনাদের!" বারোহা একটু অবাক হয়ে বললে, "আমিও জানতাম এখান থেকে ওর এখন যাবার ইচ্ছে নেই।" একটু থেমে একটু যেন দুঃখের সঙ্গে বললে,"আর্জেণ্টিনায় কোনো ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপের টাকায় এখানে গবেষণা করতে এসেছে। সেই স্কলারশিপের মেয়াদ হয়তো শেষ হয়ে গেছে। তাই নিরুপায় হয়ে যেতে হচ্ছে।"অথচ বারোহার গলায় এবার হাল্কা কৌতুকের সুরের তলায় একটু যেন ক্ষোভের আবাস পেয়েছি, "আমি কত করে আমার সঙ্গী হয়ে দেশটা আমায় যথাসম্ভব চেনাতে বলি। বলি যে তাহলে আমরা দুজনে দুজনের পরিপূরক হই।এলসা ইংরেজী জানে না আর আমি জানিনা এদেশের কোন ভাষা। দুজনে এক সঙ্গে থাকলে এদেশের ওপর-মহল নিচের-মহল কোথাও আমাদের ঠেকাতে হবে না। তা আমার কথা হেসেই উঠিয়ে দেয়।"
বারোহা-র সরল উচ্ছ্বাসের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ একটা ব্যাপার খেয়াল করে ভেতরে ভেতরে একটু চঞ্চল না হয়ে পারলাম না।
আচার্যদেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাকসি নেবার পর থেকে পরাশর এ পর্যন্ত পয়সার কোনো কথা একরকম বলে নি বললেই হয়। সে মাঝে মাঝেতার কবিতার ভাবনায় কি কোনো সমস্যার জট খোলার জন্যে আনমনা হয়ে থাকে বটে কিন্তু এতক্ষণ ধরে এরকম নীরবতা ত তার পক্ষে স্বাভাবিক নয় মোটেই। এলসাসম্বন্ধে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে বেশী রকম দুর্বল হয়ে পড়ার জন্যেই কি তার এমন ভাবান্তর? কন্দর্প আর কার্তিকে মেশানো চেহারার এই বারোহাকে এলসার এত ঘনিষ্ট বন্ধু বলে জেনে মনের ভেতরে একটা ঘা খেয়ে সে এমন গুম হয়ে গেছে। আর কিছু না হোক তার উদাসীন ভাবটা একটু ভাঙবার চেষ্টায় বারোহা-র কথার জের টেনে বললাম, "মিস এলসার ইংরেজী না জানায় একটু অসুবিধে হয় নিশ্চয়ই।"
"না। অসুবিধা আর কি?" বারোহা এলসার হয়ে বললে,"আপনাদের এখানে ইংরাজির এখনো খুব চল, কিন্তু সারা দুনিয়ায় আমাদের স্প্যানিশ-এর প্রসার বড় কম নয়। গোটা দক্ষিণ আমেরিকাই স্প্যানিশের রাজত্ব বল্তে পারেন। আর স্প্যানিশের সঙ্গে ফরাসী জানলে ত সভ্য সমাজের কোথাও ঠেকবার কথা নয়।"
নিজের ভাষার গৌরব নিয়ে বারোহা-র অহঙ্কারে একটু আমোদই পেয়ে এবার জিজ্ঞাসাকরলাম, "আচ্ছা, মিস এলসা আপনার কাছে আমাদের কি পরিচয় দিয়েছেন, বলুন ত।"
"কেন?" বারোহা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, "ভুল কিছু দিয়েছে?"
"কি দিয়েছে না জানলে ভুল কিনা বুঝব কি করে?" হেসে বললাম, "স্প্যানিশে নিস এলসা কি বলেছেন তা'ত বুঝতেপারি নি।"
"হ্যাঁ, তা ত বটে।" বলে বারোহা একতু গম্ভীর হবাই ষর ভাব করে বললে, "আপনাদেরপরিচয় যা দিয়েছে তা কিন্তু মোটেই সুবিধার নয়।"
"তাই নাকি?" আমিও গম্ভীর হলাম, "কি বলেছে, কি?"
"এলসা বলেছে," বারোহা আর হাসি চাপতে পারলে না,"আপনারা দুজনে পুলিশের লোক, এলসার পেছনে লেগেছেন কিছু একটা ব্যাপারের সন্ধানে।"
কথাটা বলে বারোহা তখন হাসছে। এতক্ষণে পরাশরকে একবার যেন সজাগ হয়ে মুখ ফেরাতে দেখে আমি একটু ভরসা পেলাম। বারোহার হাসিতে যেন ক্ষুণ্ণ হবার ভান করে বললাম, "আশ্চর্য! একথা মিস এলসা জানলেন কি করে?"
"না, না।" হাসতে হাসতে বারোহা আমায় আশ্বস্ত করে বললে, "এলসা তা বলেনি। ও বলেছে আপনারা দুজন কোনোখানে বোধহয় অধ্যাপনা করেন। আপনি বোধহয় ইতিহাস ভূগোল গোছের কিছুর আর আপনার বন্ধু পুরাতত্ত্বের। ঠিক ও নাকিজানে না। আজই নাকি আপনাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছে।"
একটু থেমে বারোহা আবার জিজ্ঞাসা করলে, "ভুল কিছু বলেছে এলসা?"
"না, না ভুল কিছু বলে নি।"আমি হেসে জানালাম।
"আপনারা নিজে থেকে ওকে ট্যাকসি ডেকে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছেন বলে ও যে কৃতজ্ঞ সে কথাও এলসা তখন জানিয়েছে। সুতরাং আমি একটু ঠাট্টা করলাম বলে ওকে ভুল বুঝবেন না।"
"না, ভুল বুঝব কেন?" ব্যস্ত হয়ে বারোহাকে আশ্বস্ত করলাম।
গাড়িটা তখন বেলেঘাটা হয়ে পার্ক-সার্কাসে এসে পৌঁছেছে। পরাশর এতক্ষণে তার নীরবতা ভঙ্গ করে গাড়িটা থামাতে অনুরোধ করলে। বারোহা গাড়ি থামাতেঅনুরোধ করলে। বারোহা গাড়িথামাবার পর বিদায় নিয়ে নেমে যেতে যেতে খুশি মনেই বললাম, "আপনার নামটা শুনে প্রথমেই আমার কার কথা মনে হয়েছিল জানেন?"
"কার কথা?" একটু অবাক হয় জিজ্ঞাসা করলে বারোহা।
"মনে হয়েছিল আপনাদের বিখ্যাত সেই লেখক পিও বারোহা-র কথা। আপনার সঙ্গে কোন সম্বন্ধ তম্বন্ধ আছে নাকি। পদবীতাএক কি না, তাই ভাবছিলাম।"
"পদবী এক।" একটু থেমে থাকার পর সজোরে হেসে উঠে বারোহা যেন আমাকেই লজ্জা দিলে। "পদবী এক হলেই সম্বন্ধ থাকবে কেন। না, নাও নামের কোনো লেখকের সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নেই।"
বারোহা গাড়ি নিয়ে চলে যাবার পর পরাশরের দিকে ফিরলাম। সে তখনো যেন কেমন অন্যমনস্কভাবে দ্মাড়িয়ে আছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, "আচ্ছা,, হঠাৎ এখানে গাড়ি থামাতে বললে কেন? বারোহা ত শহরের মাঝখানেই যচ্ছে। সেখানে কোথাও ত নেমে যেতে পারতাম।"
"তা পারতাম। তবে এখানে একটু কাজ আছে।"
"এখানে কি কাজ?" একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
উত্তর যা শুনলাম তাতে নিজের শ্রবণ শক্তিতেই প্রথম সন্দেহ জাগল।"এখানে এক জায়গায় একটু হাত দেখাব।" বললে পরাশর।