Ring ring

ভূতুরে বানর

মূলঃ স্টিফেন কিং

অনুবাদঃ অনিশ দাশ অপু

প্রভাতী প্রকাশনি
হ্যাল শেলবার্ন যখন দেখলো, তার ছেলে ডেনিশ পুরানো একটা র‌্যালস্টন-পুরিনার কার্টন থেকে বের করে আনলো ওটা, ভয়ের একটা শিহরন আর তীব্র বিবমিষা ধাক্কা দিয়ে গেল ওকে। একমুহূর্তের জন্য ইচ্ছে করলো চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলোহ্যাল মুখে হাত চাপা দিয়ে। কাশলো খুকখুক করে। টেরি বা ডেনিশ কেউ খেয়াল করলো না ব্যাপারটা। তবে পেটি কৌত‚হলী হয়ে উঠলো জিনিসটা দেখে। বড়ভাই ডেনিশকে জিজ্ঞেস করলো, ‘অ্যাই, ওটা কী?’
‘এটা একটা বানর, মাথামোটা,’বললো ডেনিশ। ওর বয়স বারো।কিন্তু নিজেকে সবজান্তা ভাবে। ‘বানর দেখিসনি কোনোদিন?’
‘আমি এটা নিই, বাবা?’ জানতেচাইলো পেটি। ওর বয়স নয়।
‘মানে!’ চেঁচালো ডেনিশ। ‘ওটা আমার। বানরটাকে আমি পেয়েছি।’
‘আহ্, চুপ র্ক না তোরা,’ দাবড়ে উঠলো ওদের মা টেরি।‘চিল্লাচিল্লিতে মাথা ধরেগেল।’
ওদের কারও কথা কানে ঢুকছেনা হ্যালের। সে ডেনিশের হাতে ধরা বানরটার দিকে তাকিয়ে আছে। বানরটা যেন হ্যালের দিকে তাকিয়ে খিকখিক হাসছে। সেই পরিচিতহাসি। যে হাসি শৈশবে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করেফিরেছে হ্যালকে।
বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস উঠলো।শিসের মতো শব্দ তুললো পাকখেতে খেতে। ভয় পেল পেটি। বাবার কাছ ঘেঁষে এলো। ‘কিসের শব্দ, বাবা?’ জিজ্ঞেস করলো সে।
‘বাতাসের শব্দ, সোনা।’ জবাব দিলো হ্যাল। স্থির তাকিয়ে আছে বানরটার দিকে।ওটার হাতে ঢোল। হাত উঁচিয়ে আছে বাজানোর ভঙ্গিতে। ‘বাতাস শিস দিতে পারে, কিন্তু সুর তুলতে জানে না,’ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললো ও। হঠাৎ মনেপড়ে গেল ঠিক একথাটাই বলতেন উইল চাচা।
লম্বা শিসের শব্দটা আবার শোনা গেল। ক্রিস্টাল লেকের ওপর দিয়ে বাতাসটা আসছে। অক্টোবরের ঠাণ্ডা বাতাস বাড়ি মারছে হ্যালেরমুখে। এ বাড়িটা তাদের হার্টফোর্ডের বাড়ির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ত্রিশ বছর আগের সময়টা যেন ফিরে এসেছে এখানে।
আমি ওই ব্যাপারটা নিয়ে আরভাববো না, সিদ্ধান্ত নিলো হ্যাল। কিন্তু ভাবতে না চাইলেই কি আর না-ভেবে থাকা যায়? ভাবছে হ্যাল, আমি ব্যাক ক্লজিটে, এরকম একটা বাক্সে বানরটাকে দেখেছিলাম।
কাঠের একটা ক্রেস্ট বোঝাইনানা হাবিজাবি জিনিস দেখছে টেরি, পেটি বাপের হাত ধরে বললো, ‘এ জায়গাটা আমার ভালো লাগছে না, বাবা।ভাইয়া ওটা নিতে চায় নিক। চলো, বাবা। এখান থেকে যাই।’
‘ভূতের ভয় লাগছে, মুরগি ছানা?’ ঠাট্টা করলো ডেনিশ।
‘আহ্, ডেনিশ থামলি!’ চাইনিজ আদলের পাতলা একটা কাপ দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললো টেরি। জিনিসটা খুব সুন্দর! হ্যাল দেখলো ডেনিশ বানরের পিঠে বসানো চাবিটা নিয়ে গুঁতোগুঁতি করছে। হিমশীতল একটা স্রোতনেমে এলো তার শিরদাঁড়া বেয়ে।
‘ওটা ঘুরাবি না!’ তীক্ষ্ম গলায় চেঁচিয়ে উঠলো হ্যাল।বুঝতে পারলো বেশি জোরে বলে ফেলেছে কথাটা। ডেনিশের সাথে এভাবে ধমকেরসুরে কথা বলে না সে অনেকদিন। ডেনিশের হাত থেকে একটানে ছিনিয়ে নিলো বানরটাকে। টেরি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো স্বামীর দিকে। ডেনিশ হতভম্ব। পেটিও অবাক। একমুহূর্তের জন্যে চুপ হয়ে গেল সবাই। আবার শিস কাটলো বাতাস। এবার আগের চেয়ে আস্তে। ‘বানরটাকে এভাবে না নিলেও পারতে,’ অভিযোগ করলো ডেনিশ। জবাবে কিছু বললো না হ্যাল। ক্যালিফোর্নিয়ার ন্যাশনাল এরোডাইন কোম্পানি থেকে চাকরিচ্যুত হবার পর থেকে তার মেজাজটা প্রায়ই খাট্টা হয়ে থাকছে।
ডেনিশ আর কিছু না বলে কার্টনটা আবার ঘাঁটতে শুরু করলো। তবে ভাঙাচোরা কিছু পুতুল ছাড়া কিছু পেলনা।
বাতাসের বেগ আবার বাড়তে শুরু করেছে। মড়মড় শব্দ হচ্ছে চিলেকোঠায়। যেন সিঁড়ি বেয়ে কেউ নামছে।
হ্যাল বললো, ‘আর এখানে নয়।চলো সবাই।’
একটা মোটেলে পাশাপাশি দুটো ঘর ভাড়া নিয়েছে হ্যাল। রাত দশটার মধ্যে ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়লো। টেরিও ঘুমাচ্ছে ঘুমের বড়িখেয়ে। বাথরুমে ঢুকলো হ্যাল। বন্ধ করে দিলো দরজা। তারপর তাকালো বানরটার দিকে।
নরম, বাদামি লোমে মোড়া বানরটার শরীর। কয়েক জায়গায় পশম উঠে বেরিয়ে পড়েছে নগ্ন গা। হাসি হাসিমুখ। ওর এই হাসিটাকে সবচেয়ে ঘৃণা করে হ্যাল। সবগুলো দাঁত বের করে আছে বানরটা। চাবি মোড়ালে ঠোঁট নড়বে, দাঁতগুলো মনে হবে আরও বড় হয়ে গেছে, অবিকল ভ্যাম্পায়ারের দাঁত। ঢোল বাজাতে শুরু করবে বানর। এই বদমাশটা হ্যালের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু জনি ম্যাকবির মৃত্যুর জন্য দায়ী। সবাই জানে জনি গাছ থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙেছে। কিন্তু হ্যালজানে এই খেলনা বানরটাই খুন করেছে তার বন্ধুকে। হ্যাল দেখেছে এটা যখন ঢং ঢং শব্দে ঢোল বাজাতে শুরু করে তখনই কারও-না-কারও করুণ মৃত্যু ঘটে। অথচ এটাকে ত্রিশ বছর আগে কুয়োয় ফেলে দিয়েছিল সে।
‘তুমি এখানে কিছুতেই আসতে পারো না,’ ফিসফিস করে বললোহ্যাল। ‘কারণ নয় বছর বয়সে তোমাকে আমি আমাদের বাড়ির কুয়োয় ফেলে দিয়েছিলাম।’
বানরটা হ্যালের কথা শুনে মুখের হাসিটা যেন প্রসারিত করলো। শিউরে উঠলো হ্যাল। হাত থেকে ফেলে দিল ওটাকে। বাইরে রাতের আঁধারে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপাদাপি। মোটেলটাকে বারবার ঝাঁকি মেরে যাচ্ছে।
হ্যালরা দুই ভাই। হ্যাল ও বিল। খুব ছোটবেলায় ওদের ব্যবসায়ী বাবা ওদেরকে ছেড়ে চলে যায়। বাবার কথা বিলের অল্প অল্প মনে আছে।কিন্তু হ্যালের স্মৃতিতে বাবার চেহারাটা নেই। হ্যালের আট বছর বয়সে মা মারা যান। বিল তখন দশে পড়েছে। তারপর ওরা হার্টফোর্ডে চলে আসে চাচা-চাচির কাছে। চাচা উইল এবং চাচি ইডা খুব আদর করতেন দুই ভাইকে। ওখানেই বড় হয়ে ওঠে ওরা। কলেজে যায়। বিল বর্তমানে পোর্টল্যান্ডে আইন ব্যবসা করছে। ভালোই পসার তার।
বানরটাকে হ্যাল প্রথম দেখেছে চার বছর বয়সে। ওদের বাবা হার্টফোর্ডে বাড়ি কিনেছিলেন, মা হোমস এয়ারক্রাফটে তখন সেক্রেটারির কাজ করেন। ছয়বছরের বিল স্কুলে যায়। হার্টফোর্ডে অনেক বেবিসিটার ছিল, নানা জায়গা থেকে আসতো। বাচ্চা দেখাশোনাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। এরকম এক কৃষ্ণাঙ্গী, বিশালদেহী বেবিসিটারের নাম ছিল বিউলাহ্। হ্যালের মা কাজেগেলে সে হ্যালের দেখাশোনাকরত। বিউলাহ্ যখন-তখন চিমটি কাটতো হ্যালকে। তারপরও হ্যাল পছন্দ করতো বিউলাহ্কে সে মজার মজার গল্প শোনতো বলে।
বানরটাকে হ্যাল খুঁজে পায়ব্যাক ক্লজিটে। সেটা ছিল মার্চের এক ঠাণ্ডা, বিষণ্য দিন।

বিউল্লাহ্ বইপড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছে, হ্যাল গেলো ক্লজিটে, তার বাবার ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দেখতে।
দোতলার বামদিকে, বাড়তি জায়গাটুকুতে ছিল ক্লজিটটা। ওটার প্রতি দারুণ আকর্ষণ অনুভব করতো হ্যাল। পুরানো ক্লজিটটাকে কখনও বার্নিশ করা হয়নি। ভেতরে রাজ্যের হাবিজাবি জিনিস। হ্যাল তার ভাইকে নিয়ে সুযোগ পেলে এখানে চলে আসে। বাক্সপেঁটরা খুঁজে দেখে, জিনিসপত্র উল্টে দেখে। প্রতিটি জিনিসের স্পর্র্শে শিহরিত হয়ে ওঠে। তারপর যেখানকার জিনিস সেখানে আবার গুছিয়েরেখে দেয়। মাঝে মাঝে হ্যাল এবং বিল ভাবে যদি তাদের হারানো বাবার সন্ধান পাওয়া যেত তাহলে কতোই না ভালো হত।
সেদিন ক্লজিটে ঢুকেছে হ্যাল, একটা বাক্স একপাশে সরিয়ে রাখতেই ওটার পেছনে আরেকটা বাক্স চোখে পড়লো। একটা র‌্যালস্টন-পুরিনা কার্টন। ওটার ওপর দিয়ে একজোড়া চকচকে চোখ জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভয়ানক চমকে গেল হ্যাল, উত্তেজনায় ধড়ফড় করতে লাগলো বুক। যেন মৃত একটা পিগমি আবিষ্কার করে ফেলেছে। একমুহূর্ত পরেই বুঝতে পারলো ওটা একটা খেলনা।
এক পা সামনে বাড়ালো হ্যাল,সাবধানে জিনিসটা তুলে নিলো বাক্স থেকে। ওটা হাসছে হ্যালের দিকে তাকিয়ে, হলদে আলোয় দাঁতগুলো বিকট দেখাল। ঢোলজোড়া আপনাআপনি সরে গেলদুইপাশে।
দারুণ! হ্যাল হাত বোলালো ওটার তুলতুলে পশমি গায়ে। মুচকি হাসিটা মজাদার এবং কৌতুককর লাগছে। পিঠে একটাচাবিও আছে। খেলনাটা নিয়ে নিচে নেমে এলো হ্যাল। খেলবে।
‘তোমার হাতে ওটা কী, হ্যাল?’ ঘুম ভেঙে জানতে চাইলো বিউলাহ্।
‘কিছু না,’ বললো হ্যাল। ‘কুড়িয়ে পেয়েছি এটাকে।’ বেডরুমে, তার পাশের শেলফের মাথায় বানরটাকে রেখে দিল হ্যাল। ওটা হাসি-হাসি মুখ করে তাকিয়েরইল শূন্যে, ঢোল বেজে ওঠারজন্য তৈরি।
সে রাতে ডিম ডিমা ডিম ডিম শব্দে ঘুম ভেঙে গেল হ্যালের। অজান্তে চোখ চলেগেল বানরটার দিকে। ঢোল বাজাতে শুরু করেছে বানর। শরীর ঝাঁকি খাচ্ছে বাজনারতালে, ঠোঁটজোড়া বারবার বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে। বিকট দেখাচ্ছে বড়ো বড়ো দাঁতগুলো।
‘থামো!’ ফিসফিস করলো হ্যাল।
হ্যালের ভাই পাশ ফিরে শুলো। নাক ডাকছে। গভীর ঘুমে অচেতন। সবকিছু নীরব...শুধু বানরটা বাদে। ঢোলে বাড়ি পড়ছে। ডিম ডিমাডিম ডিম। শব্দ শুনে ওর ভাই জেগে উঠবে, ঘুম ভেঙে যাবে মা’রও। এতই জোরালো শব্দ, লাশও উঠে পড়বে কবর ছেড়ে।
ডিম ডিমা ডিম ডিম
হ্যাল হাত বাড়ালো বানরের দিকে। এমন সময় থেমে গেল বাজনা। আবার আগের মূর্তিধরে দাঁড়িয়ে রইলো বানর। যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না।
বাড়িতে আবার নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। হ্যাল কম্বলের নিচে ঢুকতে ঢুকতেসিদ্ধান্ত নিলো কাল সকালেই বানরটাকে ক্লজিটে রেখে আসবে।
তবে পরদিন সকালে কথাটা ভুলে গেল সে। মা সেদিন কাজে গেল না। কারণ মারা গেছে বিউলাহ্। মা অবশ্য আসল কথা খুলে বললো না দুই ভাইকে। শুধু বললো, ‘ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। ভয়ানক অ্যাক্সিডেন্ট।’
সেদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটা খবরের কাগজ চুরি করে আনলোবিল জামার নিচে ঢুকিয়ে। হেডলাইনে ছিল অ্যাপার্টমেন্টে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজন মৃত। মা রান্নাঘরে সাপার তৈরিতে ব্যস্ত, খবরটা বিল পড়ে শোনালো তার ভাইকে। খবরে ছাপা হয়েছে বিউলাহ্ ম্যাককাফেরি (১৯) এবং স্যালি ট্রেমন্ট (২০)-কে গুলি করে মেরে ফেলেছে মিসম্যাককাফেরির ছেলেবন্ধু লিওনার্দ হোয়াইট (২৫)। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে লিওনার্দ গুলি করে। মিস ট্রেমন্ট হার্টফোর্ড হাসপাতালে মারা যায়, বিউলাহ্ ম্যাককাফেরির মৃত্যু ঘটে ঘটনাস্থলেই।
বিউলাহ্ খুব গোয়েন্দা গল্প পড়তো। হ্যালের খবরটাশুনে মনে হল সে তার গোয়েন্দাগল্পের চরিত্রেরমতই অদৃশ্য হয়ে গেছে। হঠাৎ মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা জলের স্রোত নামতে শুরু করলো হ্যালের, স্রোতটা পৌঁছে গেল হৃৎপিণ্ডেও। ওর মনে পড়ে গেছে খুনের ঘটনাটা যখন ঘটে ঠিক ওই সময় বানরটা বাদ্য বাজাচ্ছিল...
‘হ্যাল?’ ভেসে এলো টেরির নিদ্রাতুর কণ্ঠ। ‘ঘুমাবে না?’
বাথরুমে দাঁত মাজছিল হ্যাল, পিচিক করে থুতু ফেলে বললো, ‘আসছি।’
খানিক আগে বানরটাকে সুটকেসে ভরে ফেলেছে হ্যাল। ওরা দুই/তিনদিনের মধ্যে টেক্সাস যাচ্ছে। তার আগে ওই বদমাশের একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করা দরকার। যেন আর কোনোদিন ওটার মুখ দেখতে না হয়।
যেভাবেই হোক কাজটা করতেই হবে।
‘তুমি আজ বিকেলে ডেনিশের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছো,’ অন্ধকারে বললো টেরি।
বিকেলে হ্যালের মুখে-মুখে কথা বলার জন্যেডেনিশকে থাপ্পড় মেরেছে হ্যাল। ছেলেটা দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। অথচ পেটি কত শান্ত। এজন্যেই ছোট ছেলেটাকে বেশি ভালোবাসে হ্যাল।
‘ডেনিশের সাথে এখন থেকে একটু কড়া না হলে ছেলেটা উচ্ছন্নে যাবে,’ বললো হ্যাল।
‘কিন্তু মারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না’
‘বেশি বেয়াদবি করলে একটু-আধটু পিট্টি দিতেই হয়। তাছাড়া ডেনিশ ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।’
‘তবু তোমার আচরণ আজ আমার পছন্দ হয়নি,’ বললো টেরি।
শঙ্কিত বোধ করলো হ্যাল। বানরটা কি শুনতে পাচ্ছে তাদের আলাপচারিতা? বিকেলে ডেনিশকে মারার পরে, সন্ধ্যায় বানরটাকে দেখে হ্যালের মনে হচ্ছিল ওটা যেন এই ঘটনায় খুব মজা পেয়েছে। যদিও ডেনিশ ক্ষমাচেয়েছে হ্যালের কাছে। কিন্তু বানরটা যেন মুচকি হেসে বলছিল- তুমি কখনোই ডেনিশের সাথে অন্তরঙ্গ হতে পারবে না। সে যতই চেষ্টা করো। ওটার হাসি দেখে পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল হ্যালের। রাগের চোটে ঢুকিয়ে ফেলেছে সুটকেসে।
টেরির কথার কোনো জবাব দিলো না হ্যাল। চুপচাপ শুয়ে পড়লো বিছানায়। তবে সারারাত ঘুম এলো না। সারাক্ষণ চিন্তা করলো কীভাবে বানরটার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বানরটাকে দ্বিতীয়বার খুঁজে পেয়েছিল বিল।
সেটা ছিল বিউলাহ্ ম্যাককাফেরির মৃত্যুর দেড় বছর পরের ঘটনা। গ্রীষ্মকাল। হ্যাল মাত্র কেজি শেষ করেছে।
স্টিভি আর্লিংজেনের সাথে খেলেটেলে ঘরে ঢুকেছে হ্যাল, মা বললেন, ‘হাত মুখ ধুয়ে আয়, হ্যাল। তোকে ভাগাড়ের জন্তুর মতো লাগছে।’ মা বারান্দায়, চা খেতে খেতে বই পড়ছিলেন। তখন মা’র ছুটি চলছে। দুই হপ্তা।
হাত-মুখ ধুয়ে এলো হ্যাল, শুকনো তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো, ‘বিল কোথায়?’

‘দোতলায়। ওর ঘরটা পরিষ্কার করতে বলবি। যা দশা করে রেখেছে ঘরের।’
হ্যাল লাফাতে লাফাতে ছুটলো বড়ভাইয়ের ঘরে। বিলকে দেখল বসে আছে মেঝেতে। ব্যাক ক্লজিটের দরজা ভেজানো। বিলের হাতে বানরটা। ‘ওটা নষ্ট,’ সাথে সাথে বললো হ্যাল। ‘কাজ করেনা।’
কথাটা মিথ্যা বলেনি হ্যাল। বানরটা বিকলই ছিল।তবে বিউলাহ্’র মৃত্যুর দিনে কীভাবে যে ওটা জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল বোধগম্য হয়নি হ্যালের। অবশ্য গোটা ব্যাপারটাই তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতোমনে হয়েছে। বানরটাকে নিয়ে, বিউলাহ্’র মৃত্যুর পরে ভয়ানক সব স্বপ্নও দেখেছে হ্যাল। এক রাতে সেজেগে দেখে ওটা তার বুকে চেপে বসেছে, হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল হ্যাল। মা সাথে সাথে চলে আসেন পাশেরঘর থেকে। ছেলেকে পানি পানকরান। ভেবেছিলেন বিউলাহ্’র আকস্মিক মৃত্যুগভীর রেখাপাত করেছে হ্যালের কচি মনে। সান্ত্বনা দিয়েছেন ছেলেকে। কিন্তু হ্যালের আসল ভয়ের কারণ জানতে পারেননি।
এসব ঘটনা অস্পষ্ট মনে পড়েহ্যালের। তবে বানরটা এখনও তাকে ভীত করে তোলে। বিশেষ করে ওটার হাতের ঢোলআর বড় বড় দাঁতগুলো। ‘জানি,’হ্যালের কথা শুনে বললো বিল, ছুড়ে ফেললো বানরটাকে একপাশে। ‘এটা একটা বোকা বানর।’
বানরটা গিয়ে পড়লো বিলের বিছানায়, ছাদের দিকে মুখ, উঁচু হয়ে থাকলো ঢোল। ওটাকে দেখে খুশি হতে পারলো না হ্যাল। বললো, ‘মাতোমাকে বলেছে ঘর পরিষ্কারকরতে।’
‘সে পরে পরিষ্কার করলেও চলবে,’ বললো বিল। ‘পপসিক্ল্ কিনতে টেডির দোকানে যাবি?’
এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল হ্যাল বিষণœ মুখে। ‘নাহ্। পয়সা নেই।’
‘তোকে আমি ধার দেব,’ বললো বিল। ‘চল্।’
‘তাহলে যেতে পারি,’ কৃতজ্ঞ গলায় বললো হ্যাল। ‘বানরটাকে ক্লজিটে ভরে রেখে যাই?’
‘দরকার নেই,’ উঠে দাঁড়াল বিল, ‘পরে রাখা যাবে। এখন চল্।’
গেল হ্যাল। কারণ বিলের মেজাজ-মর্জির ওপর ভরসা নেই। সে বানরটাকে ক্লজিটেরাখতে গিয়ে পপসিক্ল্ কেনার সুযোগ হারাতে চায় না। ওরা টেডির দোকানে গেল,তারপর গেল রেক-এ। ওখানে কয়েকটা ছেলে বেসবল খেলছিল। তবে হ্যাল খুব ছোট বলে ওকে কেউ খেলায় নেয় না। সে পপসিক্ল্ খেতেখেতে খেলা দেখলো। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা।
তারপর হাতমুখ ধুয়ে, সাপার খেয়ে টিভি দেখতে দেখতে বানরটার কথা ভুলেই গেল হ্যাল। অবশ্য মা বিলকে পিট্টি দিলেন সে ঘর পরিষ্কার করেনি বলে। হ্যাল বানরটাকে দেখলো বিলের শেলফের ওপর, অটোগ্রাফ খাতার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে বানরটা কীভাবে গেল বুঝতে পারলো না হ্যাল। হয়তো মা রেখেছে।
হ্যালের এখন সাত বছর। বেবিসিটার রাখা বেহুদা খরচ। মিসেস শেলবার্ন প্রতিদিন সকালে অফিসে যাবার সময় বলে যান, ‘বিল, তোর ভাইকে দেখিস।’
সেদিন বিলকে স্কুলে থাকতেহল সেফটি প্যাট্রলবয় মিটিঙের জন্য। তাই একা বাড়ি ফিরলো হ্যাল। বাসায় ঢুকেই ফ্রিজ খুললো দুধ খাওয়ার জন্য। কিন্তু দুধের বোতল হাত ফস্কে পড়েগেল মেঝেতে। ভেঙে চৌচির। মেঝে বোঝাই ভাঙা কাচ। বানরটা হঠাৎ ডিম ডিমা ডিমডিম ঢোল বাজাতে শুরু করেছে।
পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল হ্যাল, তাকিয়ে আছে ভাঙা কাচ আর দুধের স্রোতের দিকে। প্রচণ্ড একটা ভয় গ্রাস করলো ওকে।
খানিকপর ঘুরে দাঁড়ালো হ্যাল, দ্রুত চলে এলো ওদেরঘরে। বানরটা দাঁড়িয়ে আছে বিলের শেলফের ওপর, কটমট করে তাকাচ্ছে হ্যালের দিকে। বানরটা বিলের অটোগ্রাফ খাতা ফেলে দিয়েছে বিছানায়, মুচকি মুচকি হাসছে। শরীর দুলছে বাজনার তালে। ধীরপায়ে ওটার দিকে এগোলো হ্যাল। বানরের বাজনার গতি দ্রুততর হয়ে উঠলো। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো হ্যাল, পরক্ষণে এক থাবড়ায় বানরটাকে ফেলে দিল শেলফ থেকে। উড়ে গিয়ে ওটা পড়লো বিলের বালিশে, ওখান থেকে ডিগবাজি খেয়ে মেঝেতে। তখনও ঢোল বাজিয়ে চলেছে ডিম ডিমা ডিম ডিম।
ঠিক তখন বিউলাহ্’র কথা মনেপড়ে গেল হ্যালের। বিউলাহ্যেদিন মারা যায়, সে রাতে ঠিক এভাবে ঢোল বাজিয়েছিল বানরটা।
বানরটাকে লাথি মারলো হ্যাল সর্বশক্তি দিয়ে। এবার ভয় নয়, রাগে চিৎকার করে উঠলো। মেঝে থেকে ছিটকে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খেল বানর। তারপর আর নড়লো না। হ্যাল দাঁড়িয়ে রইল। হাত মুঠো করা। পাঁজরের গায়ে বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। আশ্চর্য, ওটা এখনও মুচকি হাসছে ওর দিকেচেয়ে। চকচকে চোখ মেলে যেনবলছে- যতো ইচ্ছে লাথি মারো। কিন্তু আমি তো পুতুল বৈ কিছু নই। আচ্ছা, বলো তো তোমার মা এখন কোথায়? ব্রæক স্ট্রিট কর্নারে। একটা গাড়ি ছুটে আসছে তার দিকে। আর গাড়ির ড্রাইভারটা মাতাল। তুমি কি শুনতে পাচ্ছ বিলের খুলি ভাঙার মটমট শব্দ? দেখতে পাও ওর মগজ গলে গলে পড়ছে কান বেয়ে? হ্যাঁ নাকি না? তবে আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। আমি জানি না। আমি শুধু জানি কীভাবে আমার ঢোলটা ডিম ডিমা ডিম ডিম করে বাজে। আর তুমি জানো আমার ঢোল বাজার সময় কেউ-না-কেউ মারা যায়। এবার কার পালা, হ্যাল? তোমার? নাকি তোমারভাই’র?
রেগে বানরটার দিকে ছুটলো হ্যাল। ওকে পা দিয়ে মাড়িয়ে থেঁতলে দেবে, গায়ের ওপর উঠে লাফাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না ওটার সমস্ত যন্ত্রপাতি শরীর থেকে ছুটে পড়ে, ভয়ংকর চোখজোড়া গড়াগড়ি খায় মেঝেতে। কিন্তু বানরটার সামনে আসতেই ওটা আবার সচলহয়ে উঠলো। এবার আস্তে আস্তে বাজতে শুরু করলো ঢোল। ভয়টা আবার ফিরে এলো হ্যালের মনে। বানরটা তখন দাঁত বের করে হাসছে। যেন জেনে ফেলেছে হ্যালের কিসেভয়। কিন্তু হ্যালের রাগও হচ্ছিল প্রচণ্ড। ভয়টাকে পাত্তা না দিয়ে সে পুতুলটাকে তুলে নিলো হাতে। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে বানরটার একটাহাত ধরল। হ্যালের চেহারা বিকৃত। যেন একটা লাশ ধরে আছে। ব্যাক ক্লজিটের ছোট দরজাটা হাতড়ে খুলে ফেললো।আলো জ্বাললো। বানরটা মুচকি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। হ্যাল স্টোরেজ এলাকার মাঝ দিয়ে হামাগুড়িদিয়ে এগোলো। চারপাশে প্রচুর বাক্স। একটার ওপর আরেকটা ডাঁই করে রাখা। পুরানো কেমিকেল, কাপড় আর স্যুভেনিরের গন্ধ ভেসে এলো নাকে। হ্যাল ভাবছে : বানরটা যদি এখন আবার ঢোল বাজাতে শুরু করে আমি নির্ঘাত চিৎকার করে উঠবো।আর আমি যদি চিৎকার করি তাহলে ওটা আরও বেশি করে হাসবে। তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। লোকে আমাকে যখন এখানে খুঁজে পাবে দেখবে পাগলের মতো হাসছি আমি।

আমি পাগল হয়ে যাব! ওহ্, ঈশ্বর, দয়া করো যিশু, আমাকে পাগল হতে দিয়ো না!
ক্লজিটের দূরপ্রান্তে চলে এলো হ্যাল, দুটো বাক্সের একটা সরাতেই র‌্যালস্টন-পুরিনার বাক্সটা চোখে পড়ল। ওটার ভেতর ঢোকাল বানরটাকে। তারপর ঠেলে সরিয়ে দিল কোনার দিকে। পিছিয়ে এলো হ্যাল। হাঁপাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে কখন আবার বেজে ওঠেঢোল। ঢোল বাজলেই হয়তো বাক্স ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে বানর, লাফিয়ে পড়বে হ্যালের ওপর।
কিন্তু এসবকিছুই ঘটল না। হ্যাল বাতি নেভালো। বন্ধ করে দিল ক্লজিটের দরজা। এখনও হাঁপাচ্ছে। তবে আগেরচেয়ে ভালো লাগছে। ক্লান্তপায়ে নেমে এলো নিচে। একটাখালি ব্যাগ জোগাড় করলো। তারপর ভাঙা কাচের টুকরো তুলতে শুরু করলো মেঝে থেকে। তোয়ালে দিয়ে পরিষ্কার করলো মেঝের দুধ।শেষে অপেক্ষা করতে লাগল মা আর ভাইয়ের জন্য।
মা এলেন আগে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিল কোথায়?’ হ্যাল জানালো বিল প্যাট্রল বয় মিটিঙে গেছে। তবে ওর ফিরেআসার কথা আরও আধাঘণ্টা আগে।
হ্যালের শুকনো, নিষ্প্রাণকণ্ঠ শুনে বিচলিত বোধ করলেন মা। উদ্বিগ্ন চোখে চাইলেন ছেলের দিকে, কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছেন, ঠিক তখন খুলে গেলসদর দরজা। ভেতরে ঢুকল বিল। কিন্তু ও যেন বিল নয়। বিলের ভূত। বিষণ্ন, নীরব। ‘কী হয়েছে?’ চেঁচিয়েউঠলেন মিসেস শেলবার্ন। ‘কী হয়েছে, বিল?’
কাঁদতে শুরু করলো বিল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে চলল তার গল্প।
বিল স্কুলের মিটিং শেষে তার বন্ধু চার্লি সিলভার ম্যানকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। কিন্তু ব্যস্ত রাস্তা ব্রুক স্ট্রিট কর্নারের মোড় পার হবার সময় একটা দ্রুতগামী গাড়ি চার্লিকে চাপা দিয়ে চলে যায়।
এবার তারস্বরে কান্না শুরু করে দিল বিল, বেড়ে গেল ফোঁপানি। মা জড়িয়ে ধরলেন ওকে। সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কেঁদে ফেললো হ্যালও। তবে এটা তার স্বস্তির কান্না।
চার্লির মৃত্যু গভীর দাগ কেটে গেল বিলের মনে। সে রীতিমতো দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। চার্লির হন্তারক ড্রাইভার ধরা পড়লো। লোকটা বেহেড মাতাল হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। তবে কাস্টডিতে নেয়ার কিছুদিনপরেই হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেল সে।
হ্যাল এদিকে বানরটার কথা প্রায় ভুলেই বসেছিল। কিংবা বলা যায় গোটা ব্যাপারটা সে ধরে নিয়েছিলস্রেফ একটা দুঃস্বপ্ন হিসেবে। কিন্তু বানরের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে পারলো না সে তার মা’র মৃত্যুর কারণে।
একদিন বিকেলে হ্যাল স্কুলথেকে ফিরে এসে দেখে তার মা মরে গেছে। আর বানরটা আবার ফিরে গেছে শেলফে, ঢোলবাজার অপেক্ষায়, মুখে সেই ভয়ংকর মুচকি হাসি।
হ্যাল হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো বানরটাকে। ওটা মোচড় খেল মুঠোর মধ্যে। যেন জ্যান্ত। গুঙিয়ে উঠলো হ্যাল। আঙুল ঢুকিয়ে দিল বানরের চোখের মধ্যে। তারপর দেয়ালে ওটাকে বারবার আছাড় মারল। শেষে বাথরুমে ঢুকে হড় হড় করে বমি করে দিল হ্যাল।
জানা যায়, সেদিন বিকেলে মিসেস শেলবার্ন মারা গিয়েছিলেন মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে যাবার কারণে। ওয়াটার কুলারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনিহাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে।হঠাৎ ঝাঁকি খায় তাঁর শরীর,যেন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। হাঁটু ভেঙে পড়ে যান মিসেসশেলবার্ন। হাত থেকে ছিটকেপড়ে যায় গ্লাস। ডাক্তার বলেছেন গ্লাসের পানি মিসেস শেলবার্নের গা ভিজিয়ে দেয়ার আগেই তিনি মারা গেছেন।
দুটো রাত ভয়াবহ কেটেছে দুই ভাইয়ের। ওই দুই রাত ওদের সাথে ছিলেন প্রতিবেশী মিসেস স্টাবি। দুইদিন পরে ইডা চাচি এসে ওদেরকে নিয়ে যান নিজের বাড়িতে।
মা’র মৃত্যুদৃশ্য দুঃস্বপ্নের মতো অনেকদিন তাড়া করে ফিরেছে হ্যালকে।বড়ভাই বিল সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেছে ছোটভাইকে। কিন্তু হ্যাল সবসময় অপরাধবোধে ভুগেছে। মা’র মৃত্যুর জন্যে নিজেকে দায়ী বলে মনে হতে তাঁর। সেদিন বিকেলে স্কুলথেকে ফেরার পরে বানরটাকে লাথি মারা উচিত হয়নি। বানরটা তার প্রতিশোধ নিয়েছে।
কাল রাতে নানা কথা ভাবতে গিয়ে ঘুমাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল হ্যালের। আজ ঘুম ভেঙে দেখে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। পেটি পা আড়াআড়িভাবে মুড়ে আপেল খাচ্ছে আর টিভিতে গেম শো দেখছে।
বিছানা থেকে নেমে এলো হ্যাল। মাথাটা দপদপ করছে।
‘তোর মা কোথায়, পেটি?’ জিজ্ঞেস করলো সে।
পেটি ঘাড় ঘুরিয়ে বললো, ‘ভাইয়াকে নিয়ে শপিঙে গেছে। আমাকেও যেতে বলেছিল। আমি রাজি হইনি। আচ্ছা, বাবা, তুমি কি ঘুমের মধ্যে সবসময় কথা বলো?’
কৌতুকের দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকাল হ্যাল। ‘নাতো। কেন রে?’
‘তুমি আজ ঘুমের মধ্যে সারাক্ষণ কী যেন বিড়বিড় করছিলে। আমার ভয় লাগছিল।’
‘আর ভয় পেতে হবে না। আমি এখন ঠিক আছি।’ হাসলো হ্যাল। জবাবে পেটিও হাসলো। ছেলেটার জন্যে মায়া লাগল হ্যালের। পেটিকে ও ডেনিশের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসে এতে কোনোই সন্দেহ নেই। ডেনিশটা এরকম বেয়াদব ছিল না। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসার পরে ছেলেটা কেমন বদলে গেল।
হঠাৎ স্থির হয়ে গেল হ্যাল। বানরটা বসে আছে জানালার গরাদে। হ্যালের মনে হল ওর হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেছে, তারপর যেন ঘোড়ারমতো লাফাতে শুরু করলো। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো হ্যালের, হঠাৎ বেড়ে গেল মাথাব্যথাটা।
সুটকেস থেকে ওটা বেরিয়ে এসেছে, বসেছে জানালার ধারে। মিটিমিটি হাসছে ওর দিকে চেয়ে। যেন বলছে : ভেবেছ আমার কবল থেকে মুক্তি পাবে? আগেও এরকম ভেবেছিলে, তাই না?
হ্যাঁ, মনে মনে বলে হ্যাল,তাই ভেবেছিলাম।
‘পেটি, বানরটিকে কি তুই সুটকেস খুলে বের করেছিস?’ জিজ্ঞেস করলো হ্যাল। জবাবটা কী হবে জানাই ছিল তার। কারণ সুটকেসের তালা নিজের হাতে বন্ধ করে চাবিওভারকোটের পকেটে রেখেছিল হ্যাল।
পেটি বানরটার দিকে তাকাল, অস্বস্তি ফুটল চেহারায়। ‘না’, বললো ও। ‘মা ওখানে রেখেছে।’
‘মা রেখেছে?’
‘হ্যাঁ। তোমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে। মা তখন হাসছিল।’
‘আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে?বলছিস কী তুই?’
‘তুমি বানরটাকে সাথে নিয়ে ঘুমিয়েছিলে। আমি দাঁত মাজছিলাম। ভাইয়া ওটাকে দেখে ফেলে। সে-ও হাসছিল। বলছিল তোমাকে নাকি টেডিবিয়ার শিশুর মতো লাগছে।’
বানরটার দিকে তাকাল হ্যাল। ওর গলা এমন শুকিয়েগেছে, ঢোক গিলতেও পারছে না। বানরটাকে নিয়ে সে বিছানায় গেছে? ওটা তার সঙ্গে ছিল? ওই নোংরা জিনিসটা! ওহ্ ঈশ্বর!
ঘুরল হ্যাল, দ্রুত পা বাড়াল ক্লজিটের দিকে। সুটকেস যথাস্থানে আছে। এবং তালা মারা।

টিভি বন্ধ করে পেটি এসে দাঁড়াল বাপের পেছনে। খুব আস্তে বললো, ‘বাবা, বানরটাকে আমার একদম পছন্দহচ্ছে না।’
‘আমারও,’ সায় দিল হ্যাল।
পেটি বাবার চোখে চোখ রাখল। বোঝার চেষ্টা করলো বাবা ঠাট্টা করছে কিনা। নাহ্, সে সিরিয়াস। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল পেটি।হ্যাল টের পেল তার ছেলে কাঁপছে থরথর করে।
পেটি বাবার কানে কানে কথাবলতে শুরু করলো। যেন ভয় পাচ্ছে বানরটা শুনে ফেলবেতার কথা। গলার স্বর নিচু।‘তুমি যখন ঘুমাচ্ছিলে, বানরটাকে মনে হচ্ছিল সবসময় চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। যেখানেই যাও, অনুসরণ করে চলেছে। পাশের ঘরে গেলে মনে হবে ওটাও দেয়াল ফুঁড়ে ঢুকছে। ওটার উপস্থিতি যেন টের পাচ্ছিলাম আমি...মনে হচ্ছিল ওটা আমাকে কোনোকিছুর জন্য চাইছে।’
শিউরে উঠলো পেটি। হ্যাল শক্ত করে ধরে রইল ওকে।
পেটি বলে চলল, ‘বানরটাকে নষ্ট খেলনা বলে আমার মনে হয় না। মনে হচ্ছিল ওটা আমাকে বলছে, আমাকে জাগিয়ে তোলো, পেটি। আমরা একসাথে খেলব। তোমার বাবা আমাকে কোনোদিন জাগিয়ে তুলবে না।তুমি আমাকে জাগিয়ে তোলো, জাগিয়ে তোলো’... বলতে বলতে কেঁদে ফেলল পেটি। ‘পুতুলটা ভালো নয়। আমি ঠিকবুঝতে পারছি, বাবা। ওটাকে ফেলে দেয়া যায় না? বাবা, প্লিজ?’
বানরটা মুচকি হাসি ঠোঁটেঝুলিয়ে নির্র্নিমেষ তাকিয়েই রয়েছে হ্যালের দিকে। ওটার পেতলের ঢোলে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে ঝকমক করছে। ‘তোর মা এবং ভাইয়া কখন ফিরবে, পেটি?’ জিজ্ঞেস করলো হ্যাল।
‘বলেছে একটার মধ্যে,’ লাল চোখ জামার হাতায় মুছল পেটি। কেঁদে ফেলে বিব্রত।তবে বানরটার দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না।
‘আমি ভয়ের চোটে টিভি অন করি,’ বললো পেটি। ‘জোরে সাউন্ড দিই।’
‘ঠিক আছে, পেটি।’
‘আমার মনে হচ্ছিল বানরটাকে জাগিয়ে তুললে তুমি ঘুমের মধ্যে মরে যাবে,’ বললো পেটি। ‘খুব অদ্ভুত চিন্তা, না, বাবা?’ গলার স্বর আবার কাঁপছে ওর।
কীভাবে মৃত্যু ঘটবে আমার?ভাবছে হ্যাল। হার্ট-অ্যাটাক? নাকি আমার মা’র মতো মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে? বানরটাকে দূর করে দিতেই হবে। ভাবলো হ্যাল। কিন্তু ওটার হাত থেকে কি আদৌ রক্ষা মিলবে?
বানরটা বিদ্রুপের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে হ্যালের দিকে। যে রাতে ইডা চাচি মারা গেলেন সে রাতে কি বানরটা জেগে উঠেছিল? ভাবছে হ্যাল। তিনি কি মৃত্যুর আগে ঢোলের শব্দ শুনে গেছেন?
‘তোর চিন্তাটা অদ্ভুত না রে, বাবা,’ ছেলেকে আস্তে আস্তে বললো হ্যাল। ‘নে। ফ্লাইট ব্যাগটা গুছিয়ে রেডি হ।’
পেটি উদ্বিগ্ন চোখে তাকালবাবার দিকে। ‘কোথায় যাবে?’
‘চল্, একটু ঘুরে আসি।’ বললোহ্যাল। ‘তবে আগে ব্যাগে পার্ক থেকে বড় বড় কয়েক টুকরো পাথর নিয়ে নিবি। কেন, বুঝতে পেরেছিস?’
জ্বলজ্বল করে উঠলো পেটির চেহারা। ‘বুঝতে পেরেছি, বাবা।’
ঘড়ি দেখল হ্যাল। সোয়া বারোটা। ‘তাড়াতাড়ি র্ক। তোর মা আসার আগে চলে আসতে হবে।’
‘আমরা যাচ্ছি কোথায়?’
‘উইল চাচা এবং ইডা চাচির বাড়িতে,’ বললো হ্যাল।
হ্যাল বাথরুমে ঢুকল। জানালা দিয়ে তাকাল রাস্তায়। পেটিকে দেখা যাচ্ছে। শার্ট-জ্যাকেট গায়ে, কাঁধের ফ্লাইটব্যাগের ‘ডেলটা’ লেখাটাও পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে। পার্কের দিকে এগোচ্ছে পেটি।
পার্ক থেকে প্রমাণ সাইজেরগোটা তিনেক পাথর জোগাড় করলো। তারপর রাস্তা পার হতে শুরু করলো। মোটেলের বাথরুম থেকে ওকে এখনও লক্ষ করছে হ্যাল। মোটেলেরকোণ ঘেঁষে হঠাৎ একটা গাড়িবেরিয়ে এলো তীব্র স্পিডে।পেটি ঠিক ওই মুহূর্তে পার্ক থেকে রাস্তায় নেমেছে, এগোচ্ছে মোটেলের দিকে। এক সেকেন্ডের জন্যেগাড়ি চাপা পড়ল না পেটি। দৌড়ে পার হয়ে গেল রাস্তা।ওর পাশ দিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল গাড়ি।
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে রাস্তার দৃশ্যটা দেখছিল হ্যাল। পেটিকে নিরাপদে রাস্তা পার হতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এরই মধ্যে ঘেমে নেয়ে গেছেসে।
পেটি এলো হাঁপাতে হাঁপাতে। মুখ গোলাপি। ‘বাবা, তিনটা বড় বড় পাথর পেয়েছি। আমি-’ হঠাৎ থেমে গেল ও। ‘বাবা তুমি ঠিক আছ তো?’
‘হ্যাঁ,’ কপালের ঘাম মুছল হ্যাল। ‘ব্যাগটা নিয়ে আয়।’
ব্যাগ নিয়ে এলো পেটি। খুললো। ভেতরে বড়সড় তিনটা পাথর। বানরটাকে ধরে ব্যাগের মধ্যে ছুড়ে মারলোহ্যাল। টিং করে শব্দ হল। ঢোল বাড়ি খেয়েছে পাথরে। ব্যাগটা কাঁধে ফেলল হ্যাল। ছেলেকে বললো, ‘চল্ বাপ।’
‘যাব কী করে?’ বললো পেটি। ‘মা গাড়ি নিয়ে গেছে।’
‘একটা ব্যবস্থা হবেই,’ বলে ছেলের চুল নেড়ে দিল হ্যালআদর করে।
ডেস্ক ক্লার্ককে নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখালো হ্যাল। কুড়ি ডলার দিল। ক্লার্ক হ্যালকে নিজের লঝঝড়ে এ এমসি গ্রেমলিন গাড়িটা দিল চালাতে। রুট ৩০২ ধরে ওরা কাসকোর দিকে এগোলো। হ্যালকথা বলতে শুরু করলো ছেলেরসঙ্গে। প্রথমে আস্তে, তারপর দ্রুত হয়ে উঠলো ভঙ্গিটা। বললো হ্যালের বাবা অর্থাৎ পেটির ঠাকুরদা বানরটাকে বাইরের কোনো দেশ থেকে সম্ভবত কিনে এনেছিলেন ছেলেদের উপহার দিতে। তবে খেলনাটারমধ্যে অসাধারণত্ব কিছুই ছিল না। এরকম চাবি দেয়া খেলনা বানর লাখ লাখ আছে সারা বিশ্বের দোকানে। কিছু তৈরি হয় হংকং-এ, কিছুতাইওয়ানে, কিছু কোরিয়ায়। হ্যালের বাবার বানরটা ছিলহংকং-এর। এ বানরটাকে নিয়েশৈশব থেকে দুঃস্বপ্নের শুরু হ্যালের। ওটার মধ্যেঅশুভ, ভয়ংকর কিছু একটা আছে।
তবে পেটিকে ভয় পাইয়ে দিতেচায় না বলে অনেক কিছু চেপে গেল হ্যাল। অবশ্য পেটি বাপকে বানরের ব্যাপারে কোনো প্রশ্নও করলো না। হয়তো বাবার গল্পের সাথে নিজের কল্পনামিলিয়ে সেসব প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছে।
মা মারা যাবার পরে ইডা চাচি মায়ের মতো আগলে রেখেছিলেন হ্যাল আর বিলকে। কানেকটিকাট থেকে ওরা যেবার মেইনে চলে এল, বাড়ির অনেক হাবিজাবি জিনিস ফেলে দিয়েছিলেন ইডাচাচি। ট্রাক বোঝাই করে সেসব আবর্জনা নিয়ে গেছে এক ইটালিয়ান লোক। ওই ট্রাকে অশুভ বানরটাকেও পাচার করে দিয়েছিল হ্যাল।স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল ওটাকে আর দেখতে হবে না ভেবে।
এই ঘটনার মাস তিনেক পরে হার্টফোর্ডের বাড়ির চিলেকোঠায় হ্যালকে ইডা চাচি পাঠান ক্রিসমাস ডেকোরেশনের কিছু বাক্সপেঁটরা নিয়ে আসতে। গায়ে ধুলোটুলো মেখে মহা-উৎসাহে বাক্স নামাচ্ছিল হ্যাল, হঠাৎ একটা বাক্সের দিকে চোখ যেতে জমে যায় সে। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল ওখানেই অজ্ঞান হয়েযাবে। ওখানে, র‌্যালস্টন-

পুরিনা কার্টনের এককোণায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওটা। দাঁত বের করে হাসছে, দুহাতে ঢোল। যেন ওটা হ্যালকে বলছিল :
ভেবেছিলে আমার কাছ থেকে রেহাই পেয়ে যাবে, তাই না? আমার কাছ থেকে রেহাই পাওয়া অত সোজা না, হ্যাল। তোমাকে আমি পছন্দ করি, হ্যাল। আমরা পরস্পরের জন্য এ পৃথিবীতে এসেছি। যেমন সম্পর্ক থাকে পোষা বানরের সাথে তার প্রভুর। এখান থেকে দক্ষিণের কোথাওএক ইটালিয়ান ট্রাকঅলা চিৎহয়ে পড়ে আছে মাটিতে। তার চোখ বেরিয়ে এসেছে কোটর ছেড়ে, দাঁতের পাটিও বের হয়ে আছে মুখ থেকে। লোকটা তার নাতির জন্য উপহার হিসেবে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে সে রেখেছিল তার শেভিং কিটসেরমধ্যে। লোকটাকে আমার পছন্দ হয়নি। তাই ওকে ছুড়েফেলে দিয়ে তোমার কাছে এসেছি, হ্যাল। আমি তোমার ক্রিস্টমাস উপহার, হ্যাল।হ্যাল, আমাকে জাগিয়ে তোলো। এবার কে মারা গেছে, হ্যাল? বিল? উইল চাচা? নাকি তুমি?
হ্যাল সভয়ে চলে এসেছে ওখান থেকে। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় আরেকটু হলে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যেত। চাচিকে বলেছে সে ক্রিসমাসডেকোরেশনের বাক্স খুঁজে পায়নি। জীবনে ওই প্রথম চাচিকে মিথ্যাকথা বলে হ্যাল। চাচি তার কথা বিশ্বাস করেছেন কিনা জানেনা হ্যাল। তবে ওই রাত থেকে আবার সে বানরটাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে। একসময় সন্দেহ হতে থাকে তার বাবার অদৃশ্য হয়ে যাবার পেছনে বানরটার হাত আছে।
হ্যালদের বাড়ির পেছনে বোটহাউস। বোট হাউসটা নড়বড়ে, অনেকদিন আগের। হ্যাল ব্যাগটা ডানহাতে ধরে রেখেছে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ, কানে অস্বাভাবিক একটা গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছেঅনেকক্ষণ ধরে। ব্যাগটা খুব ভারী লাগছে হ্যালের।
‘এখানে কী হবে, বাবা?’ জিজ্ঞেস করলো পেটি।
জবাব দিল না হ্যাল। ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রেখে বললো, ‘এটা ধরবি না।’
পকেট হাতড়ে চাবির গোছা বের করলো হ্যাল। বিল দিয়েছে। গোছায় অ্যাডহেসিভ টেপ লাগানো। তাতে লেখা : ‘বোট হাউস।’
দিনটি পরিষ্কার, ঠাণ্ডা। বাতাস বইছে। আকাশ ঝকমকে নীল। লেকের পাড়ের গাছগুলোর ডাল এবং পাতা বাতাস পেয়ে নড়ছে। যেন কথাবলছে বাতাসের সঙ্গে।
তালা খুলে বোট হাউসে ঢুকলহ্যাল। স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ ঝাপটা মারলো নাকে। উইল চাচার রো বোটটা আগের মতই পড়ে আছে। বৈঠাজোড়া ঝকঝকে। যেন গতকালই নৌকা বেয়েছেন চাচা। এই নৌকায় চড়ে সে বহুবার চাচার সাথেলেকে গিয়েছে মাছ ধরতে। তবে বিলকে নিয়ে একসঙ্গে যাওয়া হয়নি। নৌকাটা ছোট। তিনজনের জায়গা হয় না। বিলচাচার সাথে আলাদাভাবে গেছে। র‌্যাম্প ধরে নৌকাটাকে টেনে আনল হ্যাল।ভাসিয়ে দিল ক্রিস্টাল লেকে। খুব গভীর লেক। একশোফুটেরও বেশি। চাচা কখনও মাঝ লেকে যাননি মাছ ধরতে।লেকের নীলচে-কালো পানি এখন স্থির।
পেটি জানতে চাইল, ‘আমাকে নেবে না, বাবা?’
হ্যাল বললো, ‘আজ নয়। পরে।’ বলে উঠে পড়ল সে নৌকায়।
ঠিক তখন তার রক্ত হিম করে দিয়ে বেজে উঠলো ঢোল- ডিম ডিমা ডিম ডিম। ব্যাগের মধ্যে বসে ঢোল বাজাচ্ছে বানর। কাঁপতে কাঁপতে ব্যাগের চেইন খুলে ফেলল হ্যাল। বানরটা বিদ্রুপের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাসছে। ঢোল বাজানো বন্ধ হয়ে গেল। হাসি-হাসি মুখটা যেন বলছে : এবার কারপালা, হ্যাল? তোমার না পেটির?
‘শয়তান!’ দাঁতে দাঁত চাপল হ্যাল। ‘দাঁড়া, তোর ব্যবস্থা করছি।’
ব্যাগের চেইন আবার বন্ধ করে ফেললো হ্যাল। তাকালো তীরের দিকে। পেটি দাঁড়িয়েআছে তীরে। হাত নাড়ছে। হাতনেড়ে প্রত্যুত্তর দিল হ্যাল।
সূর্য এখন মাথার ওপর। ঘাড়ে বিদ্ধ করছে সূর্যতাপ। ঘামতে শুরু করেছে হ্যাল। ফ্লাইটব্যাগটার দিকে একপলক তাকালো। মনে হলো...মনে হল ব্যাগটা যেন ফুলে উঠেছে। ব্যাগ থেকে নজর ফিরিয়ে নিলো হ্যাল। দ্রুত বাইতে শুরু করলো বৈঠা।
বাতাসটা ঠাণ্ডা। শুকিয়ে ফেলল ওর ঘাম, শীতল হয়ে এলোগা। কিছুক্ষণ আগেও লেকে ঢেউ ছিল না। এখন বাতাসের সাথে লেকে ঢেউ উঠতে শুরু করেছে। লেকের তীর থেকে পেটি চিৎকার করে কিছু একটা বললো তার বাপকে। কিন্তু বাতাসের শোঁ শোঁআওয়াজে শুনতে পেল না হ্যাল। কিছু একটা দেখতে ইশারা করছে পেটি। বুঝতে পারলো না হ্যাল। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইল। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। অথচ একটু আগেও ঝকমক করছিল আকাশ। লেকের ঢেউও বেড়ে গেছে বাতাসের বেগের সাথে। নৌকার গায়ে শাদা ফেনা নিয়ে ছুটে এসে ধাক্কা খাচ্ছে ঢেউ। দুলে দুলে উঠছে নৌকা।
পেটির দিকে তাকাল হ্যাল। আকাশের দিকে আঙুল তুলে কীযেন দেখাচ্ছে ছেলেটা। ওর কাছ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে হ্যাল। চিৎকার অস্পষ্ট শোনাচ্ছে।
আকাশ খুব দ্রুত ঢেকে যেতেশুরু করলো কালো মেঘে। সেইসাথে বেড়ে চলল ঢেউয়ের আকার। বিশাল বিশাল ঢেউ ছুটে এলো নৌকার দিকে। হ্যালের মনে হল ঢেউয়ের সাথে একটা ছায়া দেখতে পেয়েছে সে। খুব পরিচিত একটা ছায়া। ছুটে আসছে তারদিকে। অনেক কষ্টে গলা ঠেলে উঠে আসা চিৎকারটাকে গিলে ফেলল হ্যাল।
সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে মেঘের আড়ালে। কালো মেঘের প্রকাণ্ড ছায়া গ্রাস করলোনৌকা। সাথে সাথে ব্যাগের ভেতর থেকে ভেসে এলো ঢোলেরশব্দ- ডিম ডিমা ডিম ডিম। একঘেয়ে বাজনাটা যেন বলে চলল : এবার পেয়েছি তোমাকে,হ্যাল। লেকের গভীরতম অংশেচলে এসেছ তুমি। এবার তোমার পালা, তোমার পালা-
বৈঠাজোড়া নৌকায় তুলে চট করে ফ্লাইটব্যাগটা তুলে নিলো হ্যাল। ঢোল বেজেই চলেছে। আওয়াজ আরও জোরালো।
‘এখানে শয়তান!’ চিৎকার করেউঠলো হ্যাল। ‘এখানেই তোর মরণ!’
ভারী পাথর বোঝাই ব্যাগটা পানিতে ছুড়ে ফেলল সে।
দ্রুত ডুবতে শুরু করলো ব্যাগ। ডুবছে, হ্যাল দেখল ব্যাগের কোণা নড়ছে। তার মনে হল অনন্তকাল ধরে সে ঢোলের বাজনা শুনছে। একমুহূর্তের জন্যে মনে হললেকের খলবলে কালো পানি যেন পরিষ্কার হয়ে গেল। সেওখানে দেখতে পেল অ্যামস বুলিগানের স্টুডবেকারকে, সে এই লেকে মাছ ধরতে এসে ডুবে মরেছে। এর গল্প উইল চাচা অনেক বলেছে হ্যালকে।হ্যাল ওর মাকেও দেখতে পেলপানির মধ্যে। কঙ্কাল। দাঁত বের করে হাসছেন। উইলচাচা এবং ইডা চাচি মা’র পাশে, ঢেউয়ের তালে দোল খাচ্ছে। ব্যাগ পড়ছে, বুদ্বুদ উঠছে ওপরে। সেইসাথে শব্দ আসছে : ডিম ডিমা ডিম ডিম।
পাগলের মতো বৈঠা বাইতে শুরু করলো হ্যাল। ঠিক সেইসময় পিস্তলের গুলির মতো আওয়াজ হল দুই পায়ের মাঝখানে। ফেটে গেছে তক্তা।

পাগলের মতো বৈঠা বাইতে শুরু করলো হ্যাল। ঠিক সেইসময় পিস্তলের গুলির মতো আওয়াজ হল দুই পায়ের মাঝখানে। ফেটে গেছে তক্তা। ভাঙা তক্তার মাঝ দিয়ে হুড়হুড়িয়ে পানি ঢুকতে শুরু করলো। নৌকাটা বহু পুরানো, কাঠ হয়তো পচে গেছিল, তাই ফাটল ধরেছে তক্তায়। কিন্তু নৌকা পানিতে নামানোর সময় কোনো ফাটল বা ছিদ্র চোখে পড়েনিহ্যালের। হ্যাল নৌকা বাইতে লাগল।
হ্যাল মোটামুটি সাঁতার জানে। কিন্তু নৌকা ডুবে গেলে ফুঁসে ওঠা এই লেকে সাঁতার কেটে আদৌ লাভ হবে কিনা জানে না।
বিশ সেকেন্ড পাগলের মতো বৈঠা বাইবার পরে আবার পিস্তলের গুলির আওয়াজ হল।আবার দুটো তক্তা ফেটে গেছে। আরও পানি ঢুকতে শুরু করলো। ভিজিয়ে দিল হ্যালের জুতো। ধাতব শব্দ হতে বুঝতে পারলো পেরেক-টেরেকগুলোও ছুটে যাচ্ছে নৌকার গা থেকে।
হঠাৎ পেছন থেকে হামলা করেবসলো বাতাস। যেন ধাক্কা মেরে ওকে ফেলে দেবে লেকেরমাঝখানে। ডুবিয়ে মারবে। ভয় পেল হ্যাল। তবে একই সাথে উল্লাস বোধও করছে। কারণ মূর্তিমান আতঙ্ক বানরটার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। তার যা হবার হবে, কিন্তু শয়তানটা ডেনিশ বা পেটির কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। দূরহয়েছে শয়তানটা। এতক্ষণে ক্রিস্টাল লেকের পাতালে পৌঁছে গেছে। দূর হয়েছে চিরদিনের জন্যে।
বৈঠা বাইছে হ্যাল। আবার কাঠ ফাটার শব্দ। নৌকায় তিন ইঞ্চি পানি জমে গেছে।হঠাৎ খুবই জোরে একটা শব্দহল। সাথে সাথে একটা সিট ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেল। কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় হ্যাল। বৈঠা বেয়ে যেতে লাগলো সে। তাকেতীরে পৌঁছুতেই হবে। মুখ হাঁ করে শ্বাস করছে। ঘামেভেজা চুল বাতাসে উড়ছে।
এবার ঠিক নৌকার তলা থেকে কড়াৎ করে শব্দ হল। আঁকাবাঁকা ফাটল সৃষ্টি হলওখানে। বেগে পানি ঢুকল নৌকায়। নিমিষে ডুবিয়ে দিলহ্যালের গোড়ালি। তারপর হাঁটুর নিচের অংশ। হ্যাল বৈঠা বাইছে তো বাইছেই। তবে গতি আগের চেয়ে মন্থর।
আরেকটা তক্তা আলগা হয়ে গেল। নৌকার ফাটল দ্রুত বেড়েই চলেছে। সেইসাথে হড়হড় করে ঢুকছে পানি। ইতিমধ্যে একটা বৈঠা হারিয়ে ফেলেছে হ্যাল। দাঁড়িয়ে পড়েছে ও। নৌকাটা প্রবলভাবে এপাশ-ওপাশ দুলছে। ধাক্কার চোটে সিটের মধ্যে ধপ করে পড়ে গেল হ্যাল।
একটু পরে বসার আসনটাও ভেঙে গেল। চিৎ হয়ে পানিতেপড়ে গেল হ্যাল। ঠাণ্ডা পানিতে শিরশির করে উঠলো গা। হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো। প্রার্থনা করলো পেটি যেন না দেখে তার বাপ তার চোখের সামনে ডুবে মরছে।
একমুহূর্ত পরে প্রচণ্ড আরেকটা ঢেউ দু-টুকরো করে ফেলল নৌকাটাকে। ছিটকে লেকে পড়ে গেল হ্যাল। প্রাণপণে তীর লক্ষ্য করে সাঁতার কাটতে শুরু করলো। এত জোরে জীবনে সাঁতার কাটেনি হ্যাল। মিনিটখানেক পরে কোমর সমানপানিতে চলে এলো সে। তীর থেকে মাত্র পাঁচ গজ দূরে।
পেটি ছুটে গেল বাবার কাছে। কাঁদছে, চিৎকার করছে, হাসছে। হ্যাল এগোলো ছেলের দিকে। হঠাৎ একটা ঢেউ এসে ওকে চুবুনি দিয়ে গেল। চুবুনি খেল পেটিও। একমুহূর্ত পরে মিলন ঘটল বাপ-ছেলের। পরস্পরকে ধরে ফেলল ওরা।
বেদম হাঁপাচ্ছে হ্যাল, বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছেছেলেকে। পেটিও হাঁপাচ্ছে।
‘বাবা? ওটা সত্যি দূর হয়েছে? বানরটা?’
‘হ্যাঁ। দূর হয়েছে।’
‘নৌকাটাকে দেখলাম টুকরো হয়ে যেতে...ঠিক তোমার পাশে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল...।’
লেকের দিকে তাকাল হ্যাল। তক্তাগুলো ভাসছে পানিতে। আশ্চর্য, লেকের পানিতে ঢেউয়ের উন্মত্ততা থেমে গেছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইলো হ্যাল। আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শাদা মেঘ। কালো মেঘের চিহ্নও নেই কোথাও।
‘তুমি মেঘ দেখেছিলে?’ ফিসফিস করলো পেটি। ‘কী ভয়ানক কালো মেঘ। চোখের নিমিষে আকাশ ছেয়ে ফেললো। আমি তোমাকে ফিরে আসার জন্য কত ডাকাডাকি করলাম। কিন্তু তুমি শুনলেই না।’ কান্নায় গলা বুজে এলো পেটির।
‘এখন সব ঠিক হয়ে গেছে, সোনা।’ ওকে জড়িয়ে ধরিয়ে থাকলো হ্যাল। ‘আর ভয় নেই।’
‘তোমার খুব সাহস, বাবা।’ হ্যালের দিকে তাকাল পেটি।
‘তাই!’ মুচকি হাসলো হ্যাল।‘যা, বোট হাউসে তোয়ালে আছে। গা মুছে নে।’
‘আমরা ঘটনাটা মাকে বলব না,বাবা?’
হাসলো হ্যাল। ‘জানি না, বাপ। ও নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন চল্।’
ছেলেকে নিয়ে বোট হাউসের দিকে পা বাড়াল হ্যাল।
ব্রিজটন নিউজ থেকে ২৪ অক্টোবর, ১৯৮০
মরা মাছ রহস্য
গত হপ্তায় কাসকোর ক্রিস্টাল লেকে হঠাৎ শতশতমাছ পেট ফুলে মরে ভেসে উঠতে দেখা যায়। প্রায় সব ধরনের মাছই মরে ভেসে উঠেছে। মৎস্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, হঠাৎ মাছ কেন মরে ভেসে উঠলো সেটার কারণতাদের অজানা। তবে কর্তৃপক্ষ জেলে এবং মহিলাদের নিষেধ করেছেন ক্রিস্টাল লেকের মাছ আপাতত না ধরতে। মরা মাছ রহস্য উদ্ঘাটনের তদন্ত চলছে...
<div style="background-color: teal; border: 1px dotted red;"><font color="white"><center><b>সমাপ্ত</b></center></font></div>