গ্রীষ্মের ছুটির ঘনঘটায় ঠিক মতো বাড়ীর কাজটাও বুঝে নিতে পারলো না শুভ। কাল থেকে ২৩ দিনের লম্বা ছুটি ওর। বাবা বলেছে এবার সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাবে। উত্তেজনায় খুব সকালেই ঘুমভেঙ্গে গেল শুভর। ঘরে কোনসাড়াশব্দ নেই। তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে মনে মনে ভাবলো, যাহ্ দেরি হয়ে গেল!সবাই বুঝি ওকে ফেলে রেখেইচলে গেলো। বুকটা দুরুদুরুকরতে লাগলো। শুভ তাড়াতাড়িবাবা-মা’র রুমের দিকে গেলো। গিয়ে দেখে বাবা-মা ঘুমুচ্ছে। হঠাৎ করেই দেয়ালে রাখা ঘড়ির দিকে চোখ পড়লো। মাত্র সারে চারটা বাজে। লজ্জা পেয়ে গেলো ও।
অবশেষে শেষ হলো সব প্রস্তুতি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ওরা রওনা হলো বরিশালের উদ্দেশ্যে। ওদের গ্রামের বাড়ির নাম সাগরদী। ওদের পূর্বপুরুষ নাকি ওখানকার জমিদার ছিলো। আজও নাকি ওদের বাড়িপনেরো বিঘা জায়গা জুড়ে। সেই পুরানো আমলের কিছু কিছু বিল্ডিং-ও এখনো আছে।বাড়ির চারিদিক ঝোপ-জঙ্গলে ভরা। এই তো কিছুদিন আগেও নাকি বাড়ির পাশের বাগানে বাঘের ভয় ছিলো। বাড়ির দক্ষিণ দিকেরজঙ্গলে নাকি তেঁতুল গাছে ভুতও থাকে! তাই সহজে কেউ ওই পথ মাড়ায় না। ওরা সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি এসে পৌঁছালো। সকলেই একে একে ওদের সাথে পরিচিত হলো। তবে শুভ’র বেশি ভালো লেগেছে সবার ছোট পল্টুকে।ও যেন কথার রাজা। সবই যেনো বোঝে, এমন একটা ভাব। পল্টু শুভর কানে কানে বললো, এখনও একজনের সাথে তোমার পরিচয় হয়নি।- কার সাথে?
- বারে, সে তো আমাদের মেনুদা।
- মেনুদা! ধুর এটা কারো নাম হয় নাকি!
- বারে, হবে না কেন? ওর নামআসলে অনন্ত। দাদা চাইতো বড় হয়ে মিলিটারি হবে। তা তো হতে পারলো না, তাই তাকেহাফ নামে ডাকি মেনুদা।
পল্টু ফোকলা দাঁত বের করেহাসতে থাকে। আর তাই শুনে শুভর তো হাসতে হাসতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা!
এর মধ্যে পল্টু বললো-
- ওই তো চলে এলো। মেনুদা এসো এসো। এই হলো শুভ দা। শুভ দা এই তো মেনুদা।
এরপর জমে গেল ওদের গল্প। সে কী গল্প! শুনতে শুনতে যেনো শুভর গায়ে কাঁটা দেয়। রাতে ঘুমাতে গিয়ে নানা কথা মাথায় এসে জমতে লাগলো শুভর।
সকালে গুঞ্জনের শব্দে শুভর ঘুম ভাঙলো। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছে না কি হয়েছে।
পল্টুটাকেও দেখা যাচ্ছে না ওর কাছ থেকে জেনে নিবে। কিছুক্ষণ বাদেই পল্টু এসে হাজির। পল্টু আস্তে আস্তে বললো-
- জানি তো দাদা তুমি কি নিয়ে চিন্তা করছো। চলো তোমাকে বলছি।
- হ্যা, চল তো কি হয়েছে শুনি।
- আসলে ঠাকুর মার একটা মূর্তি হারিয়েছে। শুনেছি ওটা ঠাকুমার শ্বশুর দিয়েছিলেন। জানি না, একটা মাটির মূর্তির জন্য এত কান্না কেন। বাজার থেকে আর একটা কিনে নিলেই তো হয়।
কথা শেষ না হতেই মেনুদা এসে হাজির। সে বললো-
- নারে পল্টু, ওটা মাটির না। মূর্তিটার অনেক দাম। খুব মূল্যবান পাথরের। তবেবুঝতে পারছি না কেন যে হঠাৎ ওটা চুরি হলো। কে নিতে পারে ওটা?
মেনু দা একটু ভেবে বললো-
- চলতো দেখি জানতে পারি কিনা ওটা কে নিলো।
শুভ কেমন যেনো একটু গোয়েন্দা কাহিনীর গন্ধ পেল।ওরা বাইরে চলে এলো। বাড়িরউত্তরের জঙ্গলটা পেরিয়ে একটা ঢিবির উপর আসতেই দেখলো, বাড়ির কাজের ছেলে মিহির দাপাতে দাপাতে ছুটেআসছে। ওরা কাছে গিয়ে তো অবাক! পল্টু বললো-
- একি মিহির তোমার মুখ-হাত ফুঁলে এমন চাল কুমড়া হলো কি করে? কি হয়েছে? তোমার হাতে কি হয়েছে? ছিলে গেছে কিভাবে?
- খোকা বাবু, আমি গরু বাঁধতে গিয়ে মৌমাছির কামড়খেয়েছি। ওই দিকে যেয়ো না।তাহলে তোমাকেও কামড়াবে। আমি এখন যাই। খুব ব্যথা করছে।
মিহির হনহনিয়ে চলে গেল। মেনুদা বললো-
- গাধা কোথাকার, গরু বাঁধতে গিয়ে মৌমাছির বাসার কাছে কেন যায়! বোকামি করলে কামড় খাবে না। চলো শুভ সামনে যাই।
ওরা সামনে যেতেই দেখলো একটা আমড়া গাছে অনেক গুলোভ্রমর ভনভন করে উড়ছে। মেনুদা বললো-
- চলো চলো। এখান থেকেই ওই গাধাটা কামড় খেয়েছে। তাড়াতাড়ি সরে পড়ি, তা না হলে আমাদেরকেও ছাড়বে না।
কিছুক্ষণ বাদে ওরা বাড়ি চলে এলো। কোন কিছুই মাথায়খেলছে না। ওরা এসে ঠাকুমার কাছে গিয়ে বসে রইলো। ঠাকুমা মূর্তিটি রাখার বাক্সটা হাতে নিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে। পল্টু বললো-খুব খিদে পেয়েছে। বলে মিহিরকে জোরে ডেকে বললো-
- মিহির তাড়াতাড়ি কিছু খেতে দাও, আমাদের খিদে পেয়েছে।
পল্টু এবার ঠাকুমাকে বললো-
- কিভাবে হারালো ওটা ঠাকুমা?
- যা ভাগ বদমাশ। আমি মরি মনের কষ্টে আর ও এসেছে জানতে। শুভ বললো-
- আহা একটু বলোই না কিভাবেহলো?
- আরে কাল খাবার পর রাতে ঘুমাতে যাবার আগে চশমাটা খুলে রেখেছি। হঠাৎ ও ঘরে শব্দ পেয়ে ছুটে যাই। গিয়েদেখি একটা বিদঘুটে মাথা মোটা কে যেন বাক্সটা থেকেওটা বের করছে। আমি যখন বললাম কে কে, তখন সে বাক্সটা ফেলে মূর্তিটা রেখে পালিয়ে গেলো।
মিহির এসে খাবার দিয়ে চলেযাবে এমন সময় ঠাকুমা বললো-
- মিহির তুই কি কাল ও-ঘরে গিয়েছিলি?
- না তো বড় মা। আমি কখন গেলাম?
- ঠিক আছে তুই যা, আমার জন্য জল গরম দিতে বল।
সবাই যে যার মত হৈ চৈ করছে। এমন সময় মেনুদা বললো-
- চল তো পল্টু।
- কোথায় যাব এই অবেলায়? বাবা বকবে যে।
- চল, কিছু হবে না। একটু ঘুরে আসি। শুভ চলো যাই।
মেনুদা ওদের নিয়ে ঢিবির পাশে সেই আম গাছটার কাছে এলো। খানিক ভেবে বললো-
- এক কাজ কর। কিছু খড় জড়ো কর।
খড় জড়ো করতেই পকেট থেকে ম্যাচ বের করে বললো-
- খুব সাবধানে! খড় গুলো ওইভ্রমরের বাসার নিচে দিতে হবে।
ওরা খুব সাবধানে খড়গুলো ভ্রমরের বাসার নিচে দিলো।মেনু আস্তে করে খড়ে আগুন দিয়ে বললো চল দূরে যাই, তানা হলে ভ্রমরগুলোও আমাদেরছাড়বে না। কিছুক্ষণ পর মেনুদা বললো-
- চল ভ্রমর গুলো দূরে চলে গেছে। এবার দেখবি আসল মজা।
ওরা আস্তে আস্তে ভ্রমরের বাসার কাছে গেল। মেনুদা ভ্রমরের বাসার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে খানিক বাদেই হাতে করে বের করে আনলো সেই মূর্তিটা। ওরা তো অবাক! শুভ্রর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। পল্টু তো হাঁ করে রইলো। খুব কষ্টে পল্টু বললো-
- মেনুদা তুমি কি ভাবে জানলে এটা এখানে?
- তা পরে বলবো। চল, এখন চোরকে পাকড়াও করতে হবে। বুঝলি তো চোর কে?
- কে? - আরে ওই মিহির। অবশ্য সাথে বড়ো কেউ আছে। তা নাহলে এ কাজ করার সাহস ওর হোতো না। শোন, এই কথা আর মূর্তি পাওয়ার কথা কাউকে বলার দরকার নেই। এখন চল একটু থানায় যাবো। কাজ আছে। রাতে দেখবি আসল খেলা।
ওরা চলে গেলো।
শুভর ভেতর কেমন যেন উত্তেজনা ভর করছে। রাত বাড়ছে। ওরা ভ্রমরের বাসাওয়ালা সেই আমড়া গাছেরকাছেই একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে আছে। মশা মামারাও আজ খেপেছে। খুব মজা করে রক্ত খাচ্ছে। এমন সময় ফিসফিস শব্দ পেলো ওরা। হঠাৎ দেখলো মিহির আর সাথে আরো দু’জন ওই আম গাছের নিচে চলে এসেছে। কিছুক্ষণ পর মিহির সেই ভ্রমরের বাসার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা মূর্তি বের করে এনেছে। এমন সময় মেনুদা ওদের সামনে এক লাফে হাজির। ওরাতো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ভয় সামলে নিয়ে একজনআবার মেনুদাকে একটা লাঠি দিয়ে জোরসে মারলো। সাথে সাথে শুভ্ররাও আড়াল থেকে এক চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে এলো। এমন সময় ওদের সবাইকেঅবাক করে দিয়ে পুলিশ আড়ালথেকে বের হয়ে এলো, আর মিহিরসহ সবাইকে ধরে ফেললো। আর ততোক্ষণে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বাড়ির সবাই ছুটে এলো। এসেই জিজ্ঞেস করলো-
- কি হয়েছে এতো রাতে। পল্টু তোরা এখানে এতো রাতে কি করছিস? আবার পুলিশই বা কেন?
তখন একজন পুলিশ বললো-
- আমি বলছি শুনুন। এরপর একএক করে সব খুলে বললো পুলিশটা।
শুনে তো সবার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এবার মিহিরের হাত থেকে মূর্তিটা কেড়ে নিয়ে ঠাকুরমার হাতে দিলো পুলিশ। কিন্তু ঠাকুরমা তোঅবাক। তিনি বললেন-
- বারে! এটাতো মাটির মূর্তি। আসলটা নয়।মেনুদা বললো- আসলটা আমার কাছে। ওটা সরিয়ে আমিই ওখানে নকলটা রেখেছি, যাতে ওদের হাতে-নাতে ধরতে পারি। আবার যদি না পেয়ে ওরা অস্বীকার করে তাই। এইবলে জামার ভেতর থেকে আসল মূর্তিটা বের করে আনলো।
পল্টু বললো-
- তুমি আবার এটা কখন রাখলে?
- সন্ধ্যার পর যখন আমি বাড়ি থেকে তোদের ওখানে যাচ্ছিলাম, তখন বাজার থেকে এটা কিনে এনে রেখেছিলাম। আর বাজারে যখনযাই তখন এই লোক গুলোর সাথে মিহিরকে কথা বলতে দেখি। তখন আমি আড়ি পেতে ওদের কথা শুনি।
পল্টু বললো- কিন্তু তা বিকালে হলে আমরা তো মূর্তি পেয়েছি দুপুরে।
- হ্যাঁ। ওরা আজ এখানে আসবে এটা শুনেছি সন্ধ্যায়। আর মূর্তি যে মিহির নিয়েছে তা বুঝতে পেরেছি দুপুরেই। কিভাবে? তাহলে বলছি শোন- ঠাকুমার সাথে যখন কথা বলছি তখনই বুঝতে পেরেছি। ঠাকুমা যখনমিহিরকে বললো ‘কাল তুই কি আমার ঘরে গিয়েছিলি?’, তখনইএই চিন্তা মাথায় এলো। প্রথমত, কাল ঠাকুমা চশমা ছাড়া ছিলো। তাই মিহিরকে বিদঘুটে দেখেছিলো। কারণ চশমা ছাড়া ঠাকুমা কিছুই ভাল দেখতে পায় না। আর আজ চশমা চোখে মিহিরকে ভ্রমরের কামড়ে ওই বিদঘুটেচেহারায় দেখেই ঠাকুমার মনে সন্দেহ হয়েছিলো। সেই থেকেই শুরু। এরপর যখন দেখলাম সেই বাক্সটার গায়েরক্তের দাগ তখন আরো সন্দেহ হলো। পল্টু তোর মনে আছে, মিহিরের হাতে সেইক্ষতের দাগ?
পল্টু মাথা নাড়ে। এরপর আবার বলতে শুরু করলো মেনুদা-
- ঠাকুমা যখন কাল বলেছিলো ‘কে?’, তখন তাড়াহুড়া করতে গিয়ে মিহিরের হাত কেটে যায়। এই হলো আরো পরিস্কার। আরো পরিস্কার হলাম, যখন চিন্তা করলাম মিহির গরু বাঁধতে গিয়ে ওইভ্রমরের বাসার কাছে যাবে কেন? তাছাড়া ভ্রমর তো আর বেছে বেছে ওর মাথায় আর ডান হাতেই কামড়াবে না। তার মানে হলো ও ডান হাত দিয়ে ভ্রমরের বাসায় মূর্তিটা রেখেছিলো আর ভ্রমর তখনই ডান হাতে আর মাথায় বেশি কামড়ায়। বাঁ হাতের ফোলাটাও একটু কম।ওকে অনেক টাকা দেবে বলেছিলো বলেই মিহির এত কষ্ট সত্তে¡ও এই কাজ করেছে। তাছাড়া ওর হাত ফোলার জন্য ঔষধ আনার উসিলায় বাজারে গিয়েছিলো ওদের চুরির খবরটা দিতে। ব্যস, হয়ে গেলো।
ঠাকুমা বললো, বারে, তোরা তো গোয়েন্দা হয়ে গেলি।
পুলিশ ফিরে বললো, ঠিক তাই।ওরা যে কী কাজ করেছে তা ওরা নিজেরাই জানে না। এটাহলো একটি চক্র। দেশের মূল্যবান মূর্তিগুলো এরা চুরি করে বিদেশে পাচার করে। কোন ভাবেই এদেরকে আমরা ধরতে পারছিলাম না। মেনুদা, এর জন্য সরকার কিন্তু তোমাদেরকে পুরস্কার দেবে। তোমরা আজ আমাদের দেশের জন্য একটা বড় কাজ করে দিয়েছো। সাবাস!
এরপর থেকে পল্টুর পাকামিটা আরো একটু বেশিই বেড়ে গেল। যখন পল্টুকে কেউ বলে কী রে গোয়েন্দা, কেমন আছিস? তখন গর্বে সে যে একটা মাথা ঝাড়া দেয় না!